পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

WBO রবীন্দ্র-রচনাৱলী আমাদের জাহাজ যখন নীল সমুদ্রের ক্রুদ্ধ, হৃদয়কে ফেনিল করিয়া, সগর্বে পশ্চিমদিগন্ত ফুলহীনতার অভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিল, তখন এই কথাটাই আমি ভাবিতে লাগিলাম। স্পট দেখিতে পাইলাম, য়ুরোপীয় জাতিরা সমুদ্রকে যেদিন বরণ করিল সেইদিনই লক্ষ্মীকে বরণ করিয়াছে। আর, যাহারা মাটি কামড়াইয়া পড়িল তাহারা আর অগ্রসর হইল না, এক জায়গায় আসিয়া থামিয়া মাটি যে বাধিয়া রাখে। সে অতি স্নেহশীলা মাতার মতো সন্তানকে কোনোমতে দূরে যাইতে দেয়। না । শাক-ভাত তারি-তরকারি দিয়া পেট ভরিয়া খাওয়ায়, তাহার পরে ঘনছায়াতলে শ্যামল অঞ্চলের উপর ঘুম পাড়াইয়া দেয় । ছেলে যদি একটু ঘরের বাহির হইতে চায়। তবে তাহাকে অবেলা অযাত্রা প্রভৃতি জুজুর ভয় দেখাইয়া শান্ত করিয়া রাখে। কিন্তু, মানুষের যে দূরে যাওয়া চাই। মানুষের মন এত বড়ো যে, কেবল কাছটুকুর মধ্যে তাহার চলাফেরা বাধা পায়। জোর করিয়া সেইটুকুর মধ্যে ধরিয়া রাখিতে গেলেই, তাহার অনেকখানি বাদ পড়ে। মানুষের মধ্যে যাহারা দূরে যাইতে পাইয়াছে তাহারাই আপনাকে পূর্ণ করিতে পারিয়াছে। সমুদ্রই মানুষের সম্মুখবতী সেই অতিদূরের পথ ; দুর্লােভর দিকে, দুঃসাধ্যের দিকে সেই তো কেবলই হাত তুলিয়া তুলিয়া ডাক দিতেছে। সেই ডাক শুনিয়া যাহাদের মন উতলা হইল, যাহারা বাহির হইয়া পড়িল, তাহারাই পৃথিবীতে জিতিল। ঐ নীলাম্বুরাশির মধ্যে কৃষ্ণের বাঁশি বাজিতেছে, কুল ছাড়িয়া বাহির হইবার জন্য ডাক । পৃথিবীর একটা দিকে সমাপ্তির চেহারা, আর-একটা দিকে অসমাপ্তির। ডাঙা তৈরি হইয়া গিয়াছে ; এখনো তাহার মধ্যে যেটুকু ভাঙাগড়া চলিতেছে তাহার গতি মৃদুমন্দ, চোখে পড়েই না। সেটুকু ভাঙাগড়ারও প্রধান কারিগর জল । আর, সমুদ্রের গর্ভে এখনো সৃষ্টির কাজ শেষ হয় নাই । সমুদ্রের মজুরি করে যে-সকল নদনদী তাহারা দূর দূরান্তর হইতে বুড়ি বুড়ি কাদা বালি মাথায় করিয়া আনিতেছে। আর, কত লক্ষ লক্ষ শামুক ঝিনুক প্রবালকীট এই রাজমিন্ত্রির সৃষ্টির উপকরণ অহােরাত্র জোগাইয়া দিতেছে। ডাঙার দিকে দাড়ি পড়িয়ছে, অন্তত সেমিকোলন ; কিন্তু সমুদ্রের দিকে সমাপ্তির চিহ্ন নাই। দিগন্তব্যাপী অনিশ্চয়তার চিরাচঞ্চল রহস্যান্ধকারের মধ্যে কী যে ঘটিতেছে, তাহার ঠিকানা কে জানে। অশান্ত এবং অশ্রান্ত এই সমুদ্র ; অনন্ত তাহার উদ্যম । পৃথিবীর মধ্যে যে জাতি এই সমুদ্রকে বিশেষভাবে বরণ করিয়াছে তাহারা সমুদ্রের এই কুলহীন প্ৰয়াসকে আপনি চরিত্রের মধ্যে পাইয়াছে। তাহারাই এমন কথা বলিয়া থাকে, কোনো-একটা চরম পরিণাম মানবজীবনের লক্ষ নহে ; কেবল অবিশ্রাম-ধাবমান গতির মধ্যেই আপনাকে প্রসারিত করিয়া চলাই জীবনের উদ্দেশ্য।.তাহারা অনিশ্চিতের মধ্যে নিৰ্ভয়ে ঝাপাইয়া পড়িয়া কেবলই নব নব সম্পদকে আহরণ করিয়া আনিতেছে। তাহারা কোনো-একটা কোণে বাসা বাধিয়া বসিয়া থাকিতে পারিল না। দূর তাহাদিগকে ডাকে ; দুর্লভ তাহাদিগকে আকর্ষণ করিতে থাকে। অসন্তোষের ঢেউ দিবারাত্রি হাজার হাজার হাতুড়ি পিটাইয়া তাহদের চিত্তের মধ্যে কেবলই ভাঙাগড়ায় প্রবৃত্ত আছে । রাত্রি আসিয়া যখন সমস্ত জগতের চোখে পলক টানিয়া দেয় তখনো তাহদের কারখানাঘরের দীপচন্ম আিম যেটিতে জানেন। ইহাৱা সমাপ্তিকে স্বীকার করবেন :বিজ্ঞানের সঙ্গেইনের হাতছড়ি আর, ডাঙায় যাহারা বাসা বাধিয়াছে তাহারা কেবলই বলে, “আর নহে, আর দরকার নাই ।” তাহরী যে কেবল ক্ষুধার খাদ্যটাকে সংকীর্ণ করিতে চাহে তাহা নহে, তাহারা ক্ষুধটাকে সুন্ধ মারিয়া নিকাশ করিয়া দিতে চায়। তাহারা যেটুকু পাইয়াছে তাহাকেই কোনোমতে স্থায়ী করিবার উদ্দেশে কেবলই চারি দিকে সুনিশ্চিতে সনাতন বেড়া বাধিয়া তুলিতেছে। তাহারা মাথার দিব্য দিয়া বলিতেছে, আর যাই কর, কোনোমতে সমুদ্র পার হইতে চেষ্টা করিয়ো না। কেননা সমুদ্রের হাওয়া যদি লাগে, অনিশ্চিতের স্বাদ যদি পাও, তবে মানুষের মনের মধ্যে অসন্তোষের যে একটা নেশা আছে তাহাকে আর কে ঠেকাইয়া রাখিতে পরিবে। সেই অপরিচিত নূতনের রাগিণী লইয়া কালো সমুদ্রের বঁশির