পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পথের সঞ্চয় তখন বুঝিতে পারি, আজ গোটকয়েক খবরের কাগজের নীেকা বানাইয়া তাহারই খেলার পালের উপর আমরা যে বক্ততার ফু লাগাইতেছি তাহাতে আমাদের কিছুই হইবে না । কুলকিনারার বন্ধন ছাড়াইয়া একেবারে নীল সমুদ্রের মাঝখানে আসিয়া পড়িয়ছি। ভয় ছিল, ডাঙার জীব সমুদ্রের দোলা সহিতে পারিব না- কিন্তু, আরব-সমুদ্রে এখনো মৈসুমের মাতামতি আরম্ভ হয় নাই। কিছু চঞ্চলতা নাই তাঁহা নহে, কারণ, পশ্চিমের উজান হাওয়া বহিয়াছে, জাহাজের মুখের উপর ঢেউয়ের আঘাত লাগিতেছে, কিন্তু এখনো তাহাতে আমার শরীরের অন্তর্বিভাগে কোনো আন্দোলন উপস্থিত করিতে পারে নাই । তাই সমুদ্রের সঙ্গে আমার প্রথম সম্ভাষণটাি প্রণয়সম্ভাষণ দিয়াই শুরু হইয়াছে। মহাসাগর কবির কবিত্বটুকুকে ঝাকানি দিয়া নিঃশেষ করিয়া দেন নাই, তিনি যে ছন্দে মৃদঙ্গ বাজাইতেছেন আমার রক্তের নাচ তাহার সঙ্গে দিব্য তাল রাখিয়া চলিতে পারিতেছে । যদি হঠাৎ খেয়াল যায় এবং একবার তাহার সহস্র উদ্যত হন্তে তাণ্ডবনৃত্যের রুদ্র বোল বাজাইতে থাকেন, তাহা হইলে আর মাথা তুলিতে পারিব না। কিন্তু, ভাবখানা দেখিয়া মনে হইতেছে, ভীরু ভক্তের উপর এ যাত্রায় তাহার সেই অট্টহাস্যের তুমুল পরিহাস প্রয়োগ করবেন না। তাই জাহাজের রেলিং ধরিয়া জলের দিকে তাকাইয়া আমার দিন কাটিতেছে । শুক্লপক্ষের শেষ দিকে আমাদের যাত্রা আরম্ভ হইয়াছে। যেমন সমুদ্র তেমনি সমুদ্রের উপরকার রাত্রি ; স্থির হইয়া দাড়াইয়া দুই অন্তহীনের সুন্দর মিলনটি দেখিতে থাকি ; স্তন্ধের সঙ্গে চঞ্চলের, নীরবের সঙ্গে মুখরোর, দিগন্তব্যাপী আলাপ চুপ করিয়া শুনিয়া লই । জাহাজের দুই ধারে জ্বলম্ভ ফেনরাশি কাটিয়া কাটিয়া পড়ে, তাহার ভঙ্গীটি আমার দেখিতে বড়ো সুন্দর লাগে । ঠিক মনে হয়, যেন জাহাজটাকে ফুলের বীজকোষের মতো করিয়া তাহার দুই পাশে সাদা পাপড়ি মুহুর্তে মুহুর্তে বিকশিত হইয়া ছড়াইয়া পড়িতেছে । সম্মুখে আমার নিস্তব্ধ রাত্রে এই মহাসমুদ্রের সুগভীর কল্যলীলা, আর পশ্চাতে আমার এই জাহাজের যাত্রীদের অবিশ্রাম হাস্যালাপ আমোদ আহলাদ । যতবার আমি জাহাজে আসিয়াছি প্ৰত্যেক বারেই আমার এই কথাটি মনে হইয়াছে যে আমাদের ক্ষুদ্র জীবনটুকুর চারি দিকেই যে-একটি অক্ষুব্ধ অনন্ত রহিয়াছেন, তাহার দিকে এই যাত্রীদের এক মূহুৰ্তও তাকাইবার অবকাশ নাই । জীবনের প্রতি ইহাদের আসক্তি এত অত্যন্ত বেশি যে, জীবনের গভীর সত্যকে উপলব্ধি করিতে হইলে তাহার নিকট হইতে যতটুকু দূরে যাওয়া আবশ্যক ইহারা এক মূহুর্তের জন্যও ততটুকু দূরে যাইতে পারে না । এইজন্য ইহাদের ধর্মোপাসনা যেন একটা বিশেষ আয়োজনের ব্যাপার, নিজেকে যেন এক জায়গা হইতে বিশেষভাবে বিচ্ছিন্ন করিয়া ক্ষণকালের জন্য আর-এক জায়গায় লইয়া যাইতে হয় । এ জাহাজ মাঝখানেই দেখিতে পাইতাম মানুষ অসংকোচে অনন্তকে হাতজোড় করিয়া প্ৰণাম করিতেছে ; সমস্ত হাসিগল্পের মাঝে মাঝেই নিতান্ত সহজেই ধর্মসংগীত ধ্বনিত হুইয়া উঠিত । সসীমের সঙ্গে অসীম, জীবের সঙ্গে শিব যে একেবারে মিলিয়া আছেন । দুইয়ের সহযোগেই যে সত্য সর্বত্র পরিপূর্ণ, এই চিন্তাটা আমাদের চিত্তের মধ্যে এত সহজ হইয়া আছে যে, এ সম্বন্ধে আমাদের মনে কোনো সংকোচমাত্র নাই । কিন্তু, এই ইংরেজ যাত্রীরা তাহদের হাস্যালাপের কোনো-একটা ছেদে ধর্মসংগীত গাহিতেছে, এ কথা মনে করিতেই পারি না এবং ইহারা যদি ডেকের উপর জুয়া খেলিতে খেলিতে হঠাৎ কোনো-এক সময়ে চোখ তুলিয়া দেখিতে পায় যে ইহাদের স্বজাতীয় কেহ টােকিতে বসিয়া উপাসনা করিতেছে, তবে নিশ্চয়ই তাহাকে পাগল বলিয়া মনে করিবে এবং সকলেই মনে মনে বিরক্ত ইইয়া উঠিবে। এইজন্যই ইহাদের জীবনের মধ্যে আধ্যাত্মিক সচেতনতার একটি সহজ সুনশ্ৰী শ্ৰী দেখিতে পাই না- ইহাদের কাজকর্ম-হাস্যালাপের মধ্যে কেবলই একদিক-ঘেঁষা একটা তীব্ৰতা প্ৰকাশ পায় । এই জাহাজটার মধ্যে কী আশ্চৰ্য আয়োজন। এই-যে জাহাজ দেশকালের সঙ্গে অহরহ লড়াই করিতে করিতে চলিয়াছে, তাহার সমস্ত রহস্যটা আমাদের গোচর নহে। তাহার লৌহ কঠিন হৃৎপিণ্ড