পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V87 রবীন্দ্র-রচনাবলী তাহাকেও আমি এইখানে স্থির দাড়াইয়া অধিকার করিয়া লইয়াছি। যাহা বাধা তাঁহাই আমাকে পি, করিয়া লইয়া অগ্রসর করিয়া দিতেছে। সমস্ত সমুদ্র আমার, যেন আমারই বিরাট শরীর, যেন । আমার প্রসারিত ডানা। যাহা-কিছু আমাদের বাধা তাহাকেই আমাদের চলিবার পথ, আমাদের মুক্তি উপায় করিয়া লইতে হইবে, আমাদের প্রতি ঈশ্বরের এই আদেশ আছে। যাহারা এই আদেশ মানিয়া তাহারাই পৃথিবীতে ছাড়া পাইয়াছে। যাহারা মানে নাই এই পৃথিবীটা তাহদের পক্ষে কারাগার। নিজের গ্রামটুকু তাহাদিগকে বেড়িয়ছে, ঘরের কোণটুকু তাহাদিগকে বাধিয়াছে, প্রত্যেক পা ফেলিতে তাহাদের শিকল ঝমােঝম করে। মনের আনন্দে চলিতেছি। ভয় ছিল, সমুদ্রের দোলা আমার শরীরে সহিবে না । সে ভয় কাটিয়া গেছে। যেটুকু নাড়া খাইতেছি তাহাতে আঘাত করিতেছে না, যেন আদর করিতেছে। সমুদ্র আমাকে কোলে করিয়া বহিয়া চলিয়াছে- রুগণ বালককে তাহার পিতা যেমন করিয়া লইয়া যায় তেমনি সাবধানে । এইজন্য এ যাত্রায় এখন পর্যন্ত আমার চলিবার কোনো পীড়া নাই, চলিবাের আনন্দই ভোগ করিতেছি । কেবলমাত্র এই চলিবাের আনন্দন্টুকুই পাইব বলিয়া আমি বাহির হইয়াছি। অনেকদিন হইতে এই চলিবার, এই বাহির হইয়া পড়িবার, একটা বেগ আমাকে উতলা করিয়া তুলিতেছিল। অনেকদিন আমাদের আশ্রমের বাড়িতে দোতলার বারান্দায় একলা বসিয়া যখন আমাদের সামনের শালগাছগুলার উপরের আকাশের দিকে তাকাইয়াছি তখন সে আকাশ দূরের দিকে তাহার তর্জনী বাড়াইয়া দিয়া আমাকে সংকেত করিয়াছে। যদিও সেই আকাশটি নীরব। তবু দেশদেশান্তরের যত অপরিচিত গিরিনদী-অরণ্যের আহবান কত দিগদিগন্তর হইতে উচ্ছসিত হইয়া উঠিয়া এই আকাশের নীলিমাকে পরিপূর্ণ করিয়াছে। নিঃশব্দ আকাশ বহুদূরের সেই সমস্ত মর্মধ্বনি, সেই সমস্ত কলগুঞ্জন, আমার কাছে বহন করিয়া আনিত । আমাকে কেবলই বলিত "চলো, চলো, বাহির হইয়া এসো।' সে কোনো প্রয়োজনের চলা নহে, চলার আনন্দেই চলা । প্ৰাণ আপনি চায় চলিতে ; সেই তাহার ধর্ম। না চলিলে সে যে মৃত্যুতে গিয়া ঠেকে। এইজনা নানা প্রয়োজনের ও খেলার ছুতায় সে কেবল চলে। পদ্মার চরে শরতের সময়ে তো ইসের দল দেখিয়াছ। তাহারা কোন দুৰ্গম হিমালয়ের শিখরবেষ্টিত নির্জন সরোবরতীরের নীড় ছাড়িয়া কত দিনরাত্রি ধরিয়া উড়িতে উড়িতে এই পদ্মার বালুতটের উপর আসিয়া পড়িয়াছে। শীতের দিনে বাম্পে বরফে ভীষণ হইয়া উঠিয়া হিমালয় তাহাদিগকে তাড়া লাগাইয়া দেয়- তাহারা বাসা বদল করিতে চলে। সুতরাং সেই সময়ে ইসেন্দের পক্ষে দক্ষিণপথে যাত্রার একটা প্রয়োজন আছে বটে। কিন্তু, তত্ত্ব সেই প্রয়োজনের অধিক আর-একটা জিনিস আছে। এই-যে বহু দূরের গিরি নদী পার হইয়া উড়িয়া যাওয়া, ইহাতে এই পাখিদের ভিতরকার প্রাণের বেগ আনন্দলাভ করে। ক্ষণে ক্ষণে বাসা বদল করিবার ডাক পড়ে, তখনই সমস্ত জীবনটা নাড়া খাইয়া আপনাকে আপনি অনুভব করিবার সুযোগ 에 আমার ভিতরেও বাসা বদল করিবার ডাক পড়িয়াছিল। যে বেষ্টনের মধ্যে বসিয়া আছি সেখান হইতে আর-একটা কোথাও যাইতে হইবে । চলো, চলো চলো। ঝরনার মতো চলো, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো চলো, প্রভাতের পাখির মতো চলো, অরুণোদয়ের আলোর মতো চলো। সেইজন্যই তো পৃথিবী এমন বৃহৎ, জগৎ এমন বিচিত্র, আকাশ এমন অসীম। সেইজন্যই তো বিশ্ব জুড়িয়া অণু,পরমাণু নৃত্যু করিতেছে এবং অগণ্য নক্ষত্ৰলোক আপনি-আপিন আলোকের শিবির লইয়া প্ৰান্তচারী বেদুয়িনদের মতো আকাশের ভিতর দিয়া যে কোথায় চলিয়াছে তাহার ঠিকানা নাই । চিরকালের মতো কোনো একই জায়গায় বাসা বাধিয়া বসিব, বিশ্বের এমন ধর্মই নহে। সেইজন্যই মৃত্যুর ডাক আর কিছুই নহে, সেই বাসবদলের ডাক । জীবনকে কোনোমতেই সে কোনো সনাতন প্রাচীরের মধ্যে বন্ধ হইয়া থাকিতে দিবে না- জীবনকে সেই জীবনের পথে অগ্রসর করিবে বলিয়াই মৃত্যু। তাই আমি আজ চলিয়াছি ; রূপকথার রাজপুত্র যেমন হঠাৎ একদিন অকারণে সাত সমুদ্র পার