পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পথের সঞ্চয় 8) হইবার জন্য বাহির হইয়া পড়িত, তেমনি করিয়া আমি আজ বাহিরে চলিয়ছি। রাজকন্যা ঘুমাইয়া পডিয়াছে, সে ঘুম ভঙে না ; সোনার কাঠি চাই। একই জায়গায় একই প্রথার মধ্যে বসিয়া বসিয়া জীবনের মধ্যে জড়তা আসে ; সে অচেতন হইয়া পড়ে ; সে কেবল আপনার শয্যাটুকুকেই আঁকড়িয়া থাকে ; এই বৃহৎ পৃথিবীকে বোধ করিতেই পারে না ; তখন সোনার কাঠি খুজিয়া বাহির করিতে হইবে ; তখনই দূরে পাড়ি দেওয়া চাই ; তখন এমন একটা চেতনার দরকার যাহা আমাদের চােখের কানের মনের রুদ্ধ দ্বারে কেবলই নুতন-নূতন নূতনের আঘাত দিতে থাকিবে- যাহা আমাদের জীর্ণ পর্দটিকে টুকরা টুকরা করিয়া চিরনূতনকে উদঘাটিত করিয়া দিবে। কী বৃহৎ কী সুন্দর, কী উন্মুক্ত এই জগৎ ! কী প্ৰাণ, কী আলোক, কী আনন্দ ! মানুষ এই পৃথিবীকে ঘিরিয়া ফেলিয়া কত রকম করিয়া দেখিতেছে, ভাবিতেছে, গড়িতেছে! তাহার প্রাণের, তাহার মনের, তাহার কল্পনার লীলাক্ষেত্র কোনোখানে ফুরাইয়া গেল না। পৃথিবীকে বেষ্টন করিয়া মানুষের এই-যে মনোলোক ইহার কী অফুরান ও অদ্ভুত বৈচিত্ৰ্য । সেই সমস্তকে লইয়াই যে আমার এই পৃথিবী । এইজন্যই এই সমস্তটিকে একবার প্ৰদক্ষিণ করিয়া প্ৰত্যক্ষ দেখিবার জন্য মনের মধ্যে আহবান আসে । এই বিপুল বৈচিত্র্যকে তন্ন তন্ন করিয়া নিঃশেষে দেখিবার সাধ্য ও অবকাশ কাহারও নাই । বিশ্বকে দর্শন করিব বলিয়া তাহার সম্মুখে বাহির হইতে পারিলেই দর্শনের ফল পাওয়া যায়। যদিও এক হিসাবে বিশ্ব সর্বত্রই আছে। তবু আলস্য ছাড়িয়া, অভ্যাস কাটাইয়া, চোখ মেলিয়া, যাত্রা করিলে তবেই আমাদের দৃষ্টিশক্তির জড়িমা কাটিয়া যায় এবং আমাদের প্রাণ উদবোধিত হইয়া বিশ্বপ্রাণের স্পর্শ উপলব্ধি করে । যে নিশ্চল, যে নিরুদাম, সে লোক সেই জিনিসকেই হারাইয়া বসে যাহা একেবারেই হাতের কাছে আছে। তাই নিকটের ধনকে দুঃখ করিয়া দূরে খুঁজিয়া বাহির করিতে পরিলেই তাহাকেই অত্যন্ত নিবিড় করিয়া পাওয়া যায়। আমাদের সমস্ত ভ্রমণেরই ভিতরকার আসল উদ্দেশ্যটি এই-- যাহা আছেই, যাহা হারাইতে পারেই না, তাহাকেই কেবলই প্ৰতি পদে ‘আছে আছে আছে বলিতে বলিতে চলা- পুরাতনকে কেবলই নূতন নূতন নূতন করিয়া সমস্ত মন দিয়া ভূঁইয়া ভূঁইয়া যাওয়া । (लांश्७ि-नभूछ २* छाई ४७ss আনন্দরাপ আজ সকালে জাহাজের ছাদের উপর রেলিঙ ধরিয়া দাড়াইয়াছিলাম । আকাশের পাগুর নীল ও সমুদ্রের নিবিড় নীলিমার মাঝখান দিয়া পশ্চিম দিগন্ত হইতে মৃদুশীতল বাতাস আসিতেছিল। আমার ললাট মাধুর্যে অভিষিক্ত হইল। আমার মন বলিতে লাগিল, “এই তো তঁহার প্রসাদ সুধার প্রবাহ ।” সকল সময় মন এমন করিয়া বলে না। অনেক সময় বাহিরের সৌন্দর্যকে আমরা বাহিরে দেখিতাহাতে চোখ জুড়ায়, কিন্তু তাহাকে অন্তরে গ্রহণ করি না। ঠিক যেন অমৃতফলকে আত্মাণ করি, ७श क्षां यः न । কিন্তু সৌন্দৰ্য যেদিন অন্তরাত্মাকে প্রত্যক্ষ স্পর্শ করে সেইদিন তাহার মধ্য হইতে অসীম একেবারে উদভাসিত হইয়া উঠে। তখনই সমস্ত মন এক মুহূর্তে গান গাহিয়া উঠে নহে, নহে, এ শুধু বর্ণ নহে, গন্ধ নহে- এই তো অমৃত, এই তাহার বিশ্বব্যাপী প্ৰসাদের ধারা ।” আকাশ ও সমুদ্রের মাঝখানে প্রভাতের আলোকে এই-যে অনির্বচনীয় মাধুর্যন্তরে স্তরে দিকে দিকে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে, ইহা আছে কোনখানে । ইহা কি জলে । ইহা কি বাতাসে। এই ধারণার অতীতকে কে ধারণ করিতে পারে। ইহাই আনন্দ, ইহাই প্ৰসাদ । ইহাই দেশে দেশে, কালে কালে, অগণ্য প্রাণীর প্রাণ জুড়াইয়া দিতেছে, মন হরণ করিতেছে- ইহা আর কিছুতেই ফুরাইল না। ইহারই অমৃতম্পর্শেকত কবি কবিতা লিখিলে,