পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী অন্তর বাহির ভোরে ক্যাবিনে বিছানায় যখন প্রথম ঘুম ভাঁডিয়া গেল গবাক্ষের ভিতর দিয়া দেখিলাম, সমুদ্রে আজ ঢেউ দিয়াছে ; পশ্চিম দিক হইতে বেগে বাতাস বাহিতেছে। কান পাতিয়া তরঙ্গের কলশব্দ শুনিতে শুনিতে এক সময় মনে হইল, কোন একটা অদৃশ্যযন্ত্রে গান বাজিয়া উঠিতেছে। সে গানের শব্দ যে মেঘগৰ্জনের মতো প্রবল তাঁহা নহে, তাহা গভীর এবং বিলম্বিত ; কিন্তু, যেমন মৃদঙ্গ-করতলের বলবান শব্দের ঘটার মধ্যে বেহালার একটি তারের একটানা তান সকলকে ছাপাইয়া বুকের ভিতরে বাজিতে থাকে, তেমনি সেই ধীর গভীর সুরের অবিরাম ধারা সমন্ত আকাশের মৰ্মস্থলকে পূর্ণ করিয়া উচ্ছলিত হইতেছিল। শেষকালে এমন হইল, আমার মনের মধ্যে যে সুর শুনিতেছিলাম তাহাঁই কণ্ঠে আনিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। কিন্তু এরাপ চেষ্টা একটা দৌরাত্ম্য ; ইহাতে সেই বড়ো সুরটির শান্তি নষ্ট করিয়া দেয় ; তাই আমি চুপ করিলাম। একটা কথা আমার মনে হইল, প্ৰভাতে মহাসমুদ্র আমার মনের যন্মে। এই-যে গান জাগাইল তাহা তো বাতাসের গর্জন ও তরঙ্গের কলধ্বনির প্রতিধ্বনি নহে। তাহাকে কিছুতেই এই আকাশব্যাপী জলবাতাসের শব্দের অনুকরণ বলিতে পারি না। তাহা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ; তাহা একটি গান ; তাহাতে সুরগুলি ফুলের পাপড়ির মতো একটির পরে আর-একটি ধীরে ধীরে স্তরে স্তরে উদঘাটিত হইতেছিল । অথচ আমার মনে হইতেছিল, তাহা স্বতন্ত্র কিছুই নহে, তাহা এই সমুদ্রের বিপুল শব্দোচ্ছাসেরই অন্তরতর ধ্বনি ; এই গানই পূজামন্দিরের সুগন্ধি ধূপের ধূমের মতো আকাশকে রন্ধে রন্ধে পূর্ণ করিয়া কেবলই উপরে উঠতেছে। সমুদ্রের নিশ্বাসে নিশ্বাসে যাহা উচ্ছসিত হইতেছে তাহার বাহিরে শব্দ, তাহার অন্তরে গান । P বহিরের সঙ্গে ভিতরের একটা যোগ আছে বটে, কিন্তু সে যোগ অনুরূপতার যোগ নহে ; বরঞ্চ দেখিতে পাই, সে যোগ সম্পূৰ্ণ বৈসাদৃশ্যের যোগ। দুই মিলিয়া আছে, কিন্তু দুইয়ের মধ্যে মিল যে কোনখানে তাহা ধরিবার জো নাই। তাহা অনির্বচনীয় মিল ; তাহা প্রত্যক্ষ প্রমাণযোগ্য মিল নহে । চোখে লাগিতেছে স্পন্দনের আঘাত, আর মনে দেখিতেছি আলো ; দেহে ঠেকিতেছে বস্তু, আর চিত্তে জাগিতেছে সৌন্দৰ্য ; বাহিরে ঘটিতেছে ঘটনা, আর অন্তরে ঢেউ খেলাইয়া উঠিতেছে সুখদুঃখ । একটুর আয়তন আছে, তাহাকে বিশ্লেষণ করা যায় ; আর-একটার আয়তন নাই, তাহা অখণ্ড । এই-যে “আমি বলিতে যাহাকে বুঝি তাহ বাহিরের দিকে কত শব্দ গন্ধ স্পর্শ, কত মুহুর্তের চিন্তা ও অনুভূতি, অথচ এই সমস্তেরই ভিতর দিয়া যে-একটি জিনিস আপনি সমগ্রতায় প্রকাশ পাইতেঁছে তাহাঁই আমি এবং তাহা তাহার বাহিরের রূপের প্রতিরূপ মাত্র নহে, বরঞ্চ বাহিরের বৈপরীত্যের দ্বারাই G7 k\s RAok | বিশ্বােরাপের অন্তরতর এই অপরপকে প্রকাশ করিবার জন্যই শিল্পীদের গুণীদের এত ব্যাকুলতা। এইজন্য তঁহদের সেই চেষ্টা অনুকরণের ভিতর দিয়া কখনোই সফল হইতে পারে না। অনেক সময়ে অভ্যাসের মোহে আমাদের বোধের মধ্যে জড়তা আসে । তখন, আমরা যাহাকে দেখিতেছি কেবলমাত্র তাহাকেই দেখি। প্রত্যক্ষরাপ যখন নিজেকেই চরম বলিয়া আমাদের কাছে আত্মপরিচয় দেয়। তখন যদি সেই পরিচয়টাকেই মানিয়া লই। তবে সেই জড় পরিচয়ে আমাদের চিত্ত জাগে না । তখন পৃথিবীতে আমরা চলি, ফিরি, কাজ করি, কিন্তু পৃথিবীকে আমরা চিত্তত্বারা গ্রহণ করি না। কারণ, এই পৃথিবীর অন্তরতীয় অপরাপতই আমাদের চিত্তের সামগ্ৰী । অভ্যাসের আবরণ মোচন করিয়া সেই অপরাপ্যতাকে উদঘাটিত করিবার কাজেই কবিরা গুণীরা নিযুক্ত । এইজন্য র্তাহারা আমাদের অভ্যন্ত রূপটির অনুসরণ না করিয়া তাহাকে খুব একটা নাড়া দিয়া দেন। তাহারা এক রূপকে আর-এক রূপের মধ্যে লইয়া গিয়া তাহার চরমতার দাবিকে অগ্রাহ্য করিয়া