পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vir রবীন্দ্র-রচনাবলী করো, স্থির থাকো, মিছামিছি। কাজ বাড়াইয়ো না ইহাই আমাদের সমন্ত দেশের অনুশাসন। আর, ইহারা কেবলই বলে, “একটা-কিছু করা যাক।” এইজন্য ইহারা ছেলে বুড়া সকলে মিলিয়া কেবলই দাপদাপি করিতেছে। হাসি গল্প খেলা আমোদের বিরাম নাই, অবসান নাই। অভ্যাসের বাধা সরাইয়া দিয়া আমি যখন এই দৃশ্য দেখি আমার মনে হয়, আমি যেন বাহ্য প্রকৃতির একটা লীলা দেখিতেছি । যেন ঝরনা করিতেছে, যেন নদী চলিতেছে, যেন গাছপালা বাতাসে মাতামতি করিতেছে। আপনার সমস্ত প্রয়োজন সারিয়াও প্ৰাণের বেগ আপনাকে নিঃশেষ করিতে পারিতেছে না ; তখন সে আপনার সেই উদ্যবৃত্ত প্রাচুর্যের দ্বারা আপনাকেই আপনি প্রকাশ করিতেছে। আমরা যখন ছোটাে ছেলেকে কোথাও সঙ্গে করিয়া লইয়া যাই তখন কিছু খেলনার আয়োজন রাখি, নাহিলে তাহাকে শান্ত রাখা শক্ত হয় । কেননা, তাহার প্রাণের স্রোত তাহার প্রয়োজনের সীমাকে ছাপাইয়া চলিয়াছে। সেই উচ্ছলিত প্ৰাণের বেগ আপনার লীলার উপকরণ না পাইলে অধীর হইয়া উঠে । এইজন্যই ছেলেদের বিনা কারণে দুটাছুটি করিতে হয়, তাহারা যে চেঁচামেচি করে তাহার কোনো অর্থই নাই ঐবং তাহদের খেলা দেখিলে বিজ্ঞ ব্যক্তিার হাসি আসে এবং কাহারও কাহারও বিরক্তি বোধ হয়। কিন্তু, তাহদের এই খেলার উৎপাত আমাদের পক্ষে যত বড়ো উপদ্রব হউক, খেলা বন্ধ করিলে উপদ্রব আরো গুরুতর হইয়া উঠে সন্দেহ নাই । এই-যে য়ুরোপীয় যাত্রীরা জাহাজে চড়িয়াছে, ইহাদের জন্যও কতরকম খেলার আয়োজন রাখিতে হইয়াছে তাহার আর সংখ্যা নাই। আমাদের যদি জাহাজ থাকিত তাহা হইলে তাস পাশা প্রভৃতি অত্যন্ত ঠাণ্ডা খেলা ছাড়া এ-সমস্ত দীেড়ধাপের খেলার ব্যবস্থা করার দিকে আমরা দৃকপাতমাত্র করিতাম না । বিশেষত কয়দিনের জন্য পথ চলার মুখে এ-সমস্ত অনাবশ্যক বোঝা নিশ্চয়ই বর্জন করিতাম এবং কেহ তাহাতে কিছু মনেও করিত না । কিন্তু, য়ুরোপীয় যাত্ৰাদিগকে ঠাণ্ডা। রাখিবার জন্য খেলা চাই। তাহদের প্রাণের বেগের মধ্যে প্রাতাহিক ব্যবহারের অতিরিক্ত মস্ত একটা পরিশিষ্ট ভাগ আছে, তাহাকে চুপ করিয়া বসাইয়া রাখিবে কে । তাহাকে নিয়ত ব্যাপৃত রাখা চাই । এইজন্য খেলনার পর খেলনা জোগাইতে হয় এবং খেলার পর খেলা সৃষ্টি করিয়া তাহাকে ভুলইয়া রাখার প্রয়োজন। তাই দেখি, ইহারা ছেলেবুড়ো কেবলই ছটফট এবং মাতামতি করিতেছে। সেটা আমাদের পক্ষে একেবারেই অনাবশ্যক বলিয়া প্রথমটা কেমন অদ্ভুত ঠেকে । মনে ভাবি, বয়স্ক লোকের পক্ষে এ-সমস্ত ছেলেমানুযি নিরর্থক অসংযমের পরিচয়মাত্র। ছেলেদের খেলার বয়স বলিয়াই খেলা তাহাদিগকে শোভা পায় ; কাজের বয়সে এতটা খেলার উৎসাহ অত্যন্ত অসংগত । কিন্তু, যখন নিশ্চয় বুঝিতে পারি যুরোপীয়ের পক্ষে এই চাঞ্চল্য এবং খেলার উদ্যম নিতান্তই স্বভাবসংগীত, তখন ইহার একটি শোভনতা দেখিতে পাই । ইহা যেন বসন্তকালের অনাবশ্যক প্রাচুর্যের মতো। যত ফল ধরিবে তাহার চেয়ে অনেক বেশি মুকুল ধরিয়াছে। কিন্তু, এই অনাবশ্যক ঐশ্বৰ্য না থাকিলে আবশ্যকে পদে পদে কৃপণতা ঘটিত । ইহাদের খেলার মধ্যে কিছুমাত্র লেজার বিষয় নাই। কেননা, এই খেলা অলসের কালব্যাপন নহে ; কেননা, আমরা দেখিয়াছি, ইহাদের প্রাণের শক্তি কেবলমাত্র খেলা করে না। কর্মক্ষেত্রে এই শক্তির নিরলস উদ্যম, ইহার অপ্রতিহত প্রভাব। কী আশ্চর্যক্ষমতার সঙ্গে ইহারা সমস্ত পৃথিবী জুড়িয়া বিপুল কর্মজাল বিস্তার করিয়াছে তাহা ভাবিয়া দেখিলে স্তম্ভিত হইতে হয় । তাহার পশ্চাতে শরীর ও মনের কী অপরিমিত অধ্যবসায় নিযুক্ত। সেখানে কোথাও কিছুমাত্র জড়ত্ব নাই, শৈথিলা নাই ; সতর্কতা সর্বদা জাগ্ৰত ; সুযোগের তিলমাত্র অপব্যয় দেখা যায় না। যে শক্তি কর্মের উদ্যোগে আপনাকে সর্বদা প্রবাহিত করিতেছে সেই শক্তিই খেলার চাঞ্চলে আপনাকে তরঙ্গিত করিতেছে। শক্তির এই প্রাচুর্যকে বিজের মতো অবজ্ঞা করিতে পারি না। ইহাই মানুষের ঐশ্বৰ্যকে নব নব সৃষ্টির মধ্যে বিস্তার করিয়া চলিয়াছে। ইহা নিজেকে দিকে দিকে অনায়াসে অজস্র ত্যাগ করিতেছে, সেইজন্যই নিজেকে বহুগুণে ফিরিয়া পাইতেছে । ইহাই সাম্রাজ্যে বাণিজ্যে