পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পথের সঞ্চয় gy স্টপফোর্ড বুক আমার কোনো রচনা পড়িয়া লোকের ভালো লাগিয়াছে, ইহাতে খুশি হওয়া লজার বিষয় বলিয়া মনে করিনা। বস্তুত, খুশি হই নাই এ কথা বলার মতো অহংকার আর কিছুইনাই । যখনই কোনো বই ছাপাইয়াছি তখনই তাহার মধ্যে একটা আশা প্রচ্ছন্ন আছে যে, এ বই লোকের ভালো লাগিবে। যদি সেটাকে অহংকার বলা যায়। তবে সেই বই-ছাপানেটাই অহংকার । আমি কোনো-একটা অবকাশের কালে নিজের কতকগুলি কবিতা ও গান ইংরেজি গদ্যে তৰ্জমা করিবার চেষ্টা করিয়ছিলাম । ইংরেজি লিখিতে পারি এ অভিমান আমার কোনোকালেই নাই ; অতএব ইংরেজি রচনায় বাহবা লইবার প্রতি আমার লক্ষ্য ছিল না । কিন্তু, নিজের আবেগকে বিদেশী ভাষার মুখ হইতে আবার একটুখানি নূতন করিয়া গ্ৰহণ করিবার যে সুখ তাহা আমাকে পাইয়া বসিয়ছিল। আমি আর-এক বেশ পরাইয়া নিজের হৃদয়ের পরিচয় লইতেছিলাম । আমি বিলাতে আসার পর এই তর্জমাগুলি যখন আমার বন্ধুর হাতে পড়িল, তিনি বিশেষ সমাদর করিয়া সেগুলি গ্ৰহণ করিলেন । এবং তাহার কয়েক খণ্ড কপি করাইয়া এখানকার কয়েকজন সাহিত্যিককে পড়িতে দিলেন। আমার এই বিদেশী হাতের ইংরেজিতে আমার এই লেখাগুলি তাহদের ভালো লাগিয়াছে। বোধ হয় তাহার একটা কারণ এই যে, ইংরেজি রচনার শক্তি আমার এতটা প্রবল अष्टकल इईसा के लगे श्ल बाद बालल कण में लाल স্টপফোর্ড ব্লকের হাতে আমার এই তর্জমাগুলির একটি কপি পড়িয়ছিল। সেই উপলক্ষে তিনি একদিন আমাকে ডিনারের নিমন্ত্ৰণ করিয়াছিলেন। তিনি বৃদ্ধ, বোধ করি তাহার বয়স সত্তর বছর পর হইয়া গিয়াছে। তাহার একটা পায়ের রক্তপ্রণালীতে প্রদাহের মতো হইয়াছে, চলা তাহার পক্ষে কষ্টকর ; সেই পা একটা টােকির উপর তিনি তুলিয়া বসিয়া আছেন। বাৰ্ধক্য কোনো কোনো মানুষকে পরাভূত করিয়া পদানত করে, আবার কোনো কোনো মানুষের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করিয়া তাহার সঙ্গে বন্ধুর মতো বাস করে। ইহার শরীরমনে বার্থক্য তাহার জয়পতাকা তুলিতে পারে নাই। আশ্চর্য ইহার নবীনতা। আমার বারবার মনে হইতে লাগিল, বৃদ্ধের মধ্যে যখন যৌবনকে দেখা যায় তখনই তাহাকে সকলের চেয়ে ভালো করিয়া দেখা যায়। কেননা, সেই যৌবনই সত্যকার জিনিস ; তাহার শরীরে রক্তমাংসের সহিত জীর্ণ হইতে জানে না ; তাহার রোগ্যতাপকে আপনার জোরেই উপেক্ষা করিতে পারে। র্তাহার দেহের আয়তন বিপুল, তাহার মুখশ্ৰী সুন্দর ; কেবল তাহার পীড়িত পায়ের দিকে তাকাইয়া মনে হইল, অর্জন যখন দ্রোণাচার্যের সঙ্গে যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইয়াছিলেন তখন প্ৰণামিনিবেদনের স্বরূপ প্রথম তীর তঁহার পায়ের তলায় ফেলিয়াছিলেন, তেমনি বার্থক্য তাহার যুদ্ধ-আরম্ভের প্রথম তীরটা ইহার পায়ের কাছে নিক্ষেপ করিয়াছে। বিধাতা যে জীবনটা ইহাকে দান করিয়াছেন সেটাকে সকল দিক হইতে আনন্দের সামগ্ৰী করিয়া দিয়াছেন ; ছবি, কবিতা, প্রকৃতির সৌন্দর্য, এবং লোকালয়ে মানব-জীবনের বিচিত্র লীলা, সকলের প্রতিই তাহার চিত্তের ঔৎসুক্য প্রবল। চারিদিকের জগতের এই স্পর্শানুভূতি, এই রসগ্রেহণের শক্তি তাহার বয়োকৃদ্ধির সঙ্গে কিমিয়া আসে নাই। এই গ্রহণের শক্তিই তো যৌবন। ইহার ধর্মোপদেশ ও কাব্যসমালোচনা আমি পূর্বেই পড়িয়ছি। সেদিন দেখিলাম, ছবি আঁকাতেও ইহার বিলাস। ইহার আকা প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি ঘরের কোণে অনেক জমা হইয়া আছে। এগুলি সব মন হইতে আঁকা। আমার চিত্রশিল্পী বন্ধু এই ছবিগুলি দেখিয়া বিশেষ করিয়া প্রশংসা করিলেন। এ ছবিগুলি যে প্রদর্শনীতে দিবার বা লোকের মনোরজন করিবার জন্য তাহা নহে, ইহা নিতান্তই মনের লীলা মাত্র। সেই কথাই আমি ভাবিতেছিলাম-ইহার বয়স অনেক হইয়াছে, লেখাও অনেক লিখিতে হয়, শরীরও সম্পূর্ণসুস্থানহে, কিন্তু ইহাতেও ইহার উদ্যমের শেষ হয় নাই। জীবনীশক্তির প্রবলতা এত কাজের সঙ্গে খেলা করিবারও অবকাশ পায়। বস্তুত এই খেলার দ্বারাই প্ৰাণের পরিচয় পাওয়া যায়।