পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ಇ &9ዒዩ) অথচ, এই শুভবুদ্ধিই জাতীয় উন্নতির পক্ষে মানুষের চরম সম্বল। এমন অবস্থায় যখন এখানকার মনীষীসম্প্রদায়ের মধ্যে এক দলকে দেখিতে পাই যাহারা জাতীয় স্বার্থপরতা অপেক্ষা জাতীয় ন্যায়পরতাকেই সমাদর করিয়া থাকেন, তখন বুঝিতে পারি, দেহের মধ্যে এক দিকে ব্যাধির প্রবেশদ্বারও যেমন খোলা আছে তেমনি আর-এক দিকে স্বাস্থ্যতত্ত্বও উদ্যমের সহিত কাজ করিতেছে। যতক্ষণ এই জিনিসটি আছে ততক্ষণ আশা আছে। এই শুভবুদ্ধিটিকে এখানকার ভাবুক লোকদের অনেকের মধ্যে অনুভব করা যায়। এখানে ভাবের ক্ষেত্র এবং কাজের কারখানা পাশাপাশি আছে। এখানে রাষ্ট্রনীতির সিংহাসন ও ধর্মনীতির বেদী পরস্পর নিকটবতী । এইজন্য উভয়ের সহযোগে এখানকার দুই চাকার রথ চলিতেছে । মাঝে মাঝে এক-একটা সময় আসে যখন কাজের ধোওয়া ভাবের হাওয়াকে একেবারে কালো করিয়া তোলে ; তখন এখানে কাব্যে সাহিত্যেও পালোয়ানি আস্ফালনে তাল ঠুকিবার আওয়াজটাই সমস্ত সংগীতকে ঢাকিয়া ফেলিতে চায় ; হঠাৎ তখন দেশের রক্তের মধ্যে Jingo-বিষ প্রবল হইয়া উঠে এবং সেই চোখরাঙানির দিকে লোকে মনুষ্যত্বের উচ্চতর সাধনাকে ধর্মভীরু দুর্বলের কাপুরুষতা বলিয়াই গণ্য করে। কিন্তু, সেই উন্মত্ত বিকারের সময়েও ধর্মবুদ্ধি একেবারে হাল ছাড়িয়া দেয় না ; সেইজন্য বোয়ার যুদ্ধের দিনেও এখানেও একদল লোক ছিলেন যাহারা সমস্ত দেশের আক্রোশকে বুক পাতিয়া সহ্য করিয়াও নায়ের জয়ধ্বজাকে উপরে তুলিয়া ধরিবার চেষ্টা করিয়াছেন। ইহারাই দেশের হাতে মারা খাইয়াও, দেশবিদ্বেষী অপবাদ সহ্য করিয়াও, দেশের পাপক্ষালনের কাজে অপরাজিতচিত্তে নিযুক্ত আছেন । কিন্তু, ভারতবর্ষে ইংরেজের যে শাসনতন্ত্ৰ আছে সেটা একেবারে ঘোরতর কাজের ক্ষেত্রের মাঝখানে । সেই কাজের বিষকে শোধিত করিতে পারে এমনতরো ভাবের হাওয়া সেখানে প্রবল নহে । এই কারণে এই বিষ ভিতরে ভিতরে সঞ্চিত হইয়া উঠিতেছে। যে ইংরেজ অল্পবয়সে কোনোমতে একটা কঠিন পরীক্ষা পাস করিয়া সেখানে রাজ্য চালনা করিতে যান। তিনি একবারে সেখানকার বিষাক্ত তপ্ত হাওয়ার ভিতরে গিয়া প্ৰবেশ করেন। সেখানে ক্ষমতার মদ অত্যন্ত কড়া, সেলামের মোহ মজার মধ্যে জড়িত হইয়া যায়, এবং প্রেস্টিজের অভিমান ধর্মের কাছেও মাথা ইট করিতে চায় না। অথচ, সেইখানেই ইংলন্ডের সেই ভাবুকমণ্ডলীর সংসৰ্গনাই র্যাহারা বিকৃতিনিবারণের বড়ো মন্ত্রগুলিকে সর্বদা আবৃত্তি করিতে পারেন। এইজন্য ভারতবষীয় ইংরেজ আমাদের চিত্তকে এমন করিয়া ঠেলিয়া রাখে ; এইজন্য ভারতবর্ষের বড়ো পরিচয়টা কোনোমতেই ভারতবর্ষের ইংরেজ লাভ ৷ করে না । আমরা তাহদের কাছে অত্যন্ত ছোটাে ; আমাদের সাহিত্য, আমাদের ধর্মান্দোলন, আমাদের স্বদেশহিতৈবিতার সাধনাতাহাদের কাছে একেবারেই নাই। আমরা তাহদেরবাজারের খরিদার, আপিসের কেরানি, বারিস্টারের বাবু, আদালতের আসামি ফরিয়াদি। তাহারা পূর্ণ মানবচিত্ত দিয়া আমাদের দেখে না, আমাদেরও পূর্ণ মানবপরিচয় তাহারা পায় না। এ অবস্থায় শাসনসংরক্ষণ কাজের ব্যবস্থা সমস্তই খুব পাকা হইতে পারে, কিন্তু তাহার চেয়ে বড়ো জিনিসটা নষ্ট হয়। কারণ, মঙ্গল তো শৃঙ্খলা নহে ; এবং মানুষের কাছ হইতে কোনো ভালো জিনিস পাইলে সেইসঙ্গে যদি মানুষকেও না পাই তবে সে দান আমরা সমন্ত মনপ্ৰাণ দিয়া গ্ৰহণ করিতে পারি না ; সুতরাং সে দান না। দাতাকে ধন্য করে, না গ্ৰহীতাকে পরিতৃপ্ত করিয়া তোলে।