পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী জোরের সঙ্গে ভাবিতে পারেন ও জোরের সঙ্গে বলিতে পারেন। সে জোর কিছুমাত্র গায়ের জোর নহে, তাহা চিন্তার জোর। ইহার অনুভূতিশক্তিও দ্রুত এবং প্রবল। যেটা ভালো লাগিব।ার জিনিস সেটাকে ভালো লাগিতে ইহার ক্ষণমাত্র বিলম্ব হয় না, সে সম্বন্ধে ইহাকে আর-কাহারও মুখাপেক্ষা করিতে হয় না ; যেটাকে গ্ৰহণ করিতে হইবে সেটাকে ইনি একেবারেই অসংশয়ে গ্ৰহণ করেন। মানুষকে ও মানুষের শক্তিকে গ্ৰহণ করিবার সহজ ক্ষমতা ইহার এমন প্ৰবল বলিয়াই ইনিইহার দেশের নানা শক্তিশালী নানা শ্রেণীর লোককে এমন করিয়া বন্ধুত্বপাশে বঁধিতে পারিয়াছেন। তাহারা কেহ বা কবি, কেহ সমালোচক, কেহ বৈজ্ঞানিক, কেহ দার্শনিক, কেহ গুণী, কেহ জ্ঞানী, কেহ রসিক, কেহ। রসজ্ঞ ; তঁাহারা সকলেই বিনা বাধায় এক ক্ষেত্রে মিলিবার মতো লোক নহেন, কিন্তু তঁহার মধ্যে সকলেই মিলিতে পারিয়াছেন । আমার বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিতে গিয়া আমার ইহাই মনে হইতে থাকে, অনেক বিষয়েই ইহাদিগকে এখন আর গোড়া হইতেই ভাবিতে হয় না ; ইহারা অনেক কথা অনেকদূর পর্যন্ত ভাবিয়া রাখিয়াছেন । ভাবনার প্রথম ধাক্কাতেই যত বিলম্ব, তখনই জড়িত্ব ভাঙিতে সময় লাগে ; কিন্তু যখন তাহা কিছুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হইয়াছে তখন তাহার পক্ষে চলা সহজ। ইহাদের দেশে ভাবনা জিনিসটা চলার মুখেই আছে; তাহার চাকা আপনিই সরে। মানুষের চিন্তার অধিকাংশ বিষয়ই মােঝ-রাস্তায় । এইজন্য ইহাদের কোনো শিক্ষিত লোকের সঙ্গে যখন আলাপ করা যায়। তখন একেবারেই সুচিন্তিত কথার ধারা পাওয়া যায়, এবং সেই ধারা দ্রুতগতিশীল । যেখানে চিন্তার এমন একটা বেগ আছে সেখানে চিন্তার আনন্দ যে কতখানি তাহ সহজেই অনুভব করা যায় । সেই আনন্দ এখানকার শিক্ষিতসমাজের সামাজিকতার একটি প্রধান অঙ্গ ! এখানকার সামাজিক মেলামেশার মধ্যে চিত্তের লীলা আপনার বিহারক্ষেত্র রচনা করিতেছে। চিন্তার সঞ্চার কেবল বক্তৃতায় এবং বই লেখায় নহে, তাহা মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখা-সাক্ষাতে । অনেক সময় ইহাদের আলাপ শুনিতে শুনিতে আমার মনে হইয়াছে, এ-সব কথা লিখিয়া রাখিবার জিনিস, ছড়াইয়া ফেলিবাের নহে। কিন্তু, মানুষের মন কৃপণতা করিয়া কোনো বড়ো ফল পাইতে পারে না। যেখানে ছড়াইয়া ফেলিবার যোগ্যতা নাই। সেখানে ভালো করিয়া কাজে লাগাইবার যোগ্যতাও নাই। প্রত্যেক বীজের হিসাব রাখিয়া টিপিয়া টিপিয়া পুঁতিতে গেলে বড়ো রকমের চাষ হয় না। দরাজ হাতে ছড়াইয়া ছড়াইয়া চলিতে হয়, তাহাতে অনেকটা নিম্বফল হইয়াও মোটের উপর লাভ দাড়ায় । এইজন্য চিন্তার চচাঁয় সেই আনন্দ থাকা চাই যাহাতে সে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি হইয়া জন্মিতে পারে । আমাদের দেশে চিত্তের সেই আনন্দলীলার অভাবটাই সকল দৈন্যের চেয়ে বেশি বলিয়া ঠেকে । কেমব্রিজের কলেজ-ভবনে একজন অধ্যাপকের বাড়িতে নিমন্বিত হইয়া আমি দিন দুয়েক বাস করিয়ছিলাম। ইহার নাম লোয়েস ডিকিন্সন । ইনিই 'জন চীনাম্যানের পত্র বইখানির লেখক । সে বইখানি যখন প্রথম বাহির হয় তখন আমাদের দেশে প্রাচ্যদেশাভিমানের একটা প্রবল হাওয়া দিয়াছিল। সমস্ত যুরোপের চিত্ত যেমন একই সভ্যতাসূত্রের চারিদিকে, দানা বাধিয়াছে তেমনি করিয়া একদিন সমস্ত এসিয়া এক সভ্যতার বৃন্তের উপর একটি শতদলপদ্ম হইয়া বিশ্ববিধাতার চরণতলে নৈবেদ্যরূপে জাগিয়া উঠিবে, এইকল্পনা ও কামনা আমাদিগকে মাতাইয়া তুলিতেছিল। সেই সময়ে এই ‘চীনাম্যানের পত্র বইখানি অবলম্বন করিয়া আমি এক মন্ত প্ৰবন্ধ লিখিয়া সভায় পাঠ করিয়াছিলাম * তখন জানিতাম, সে বইখানি সত্যই চীনামানের লেখা। যিনি লেখক। তঁহাকে দেখিলাম ; তিনি চীনামান নহেন তাঁহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু, তিনি ভাবুক, অতএব তিনি সকল দেশের মানুষ। যে দুইদিন ইহার বাসায় ছিলাম ইহার সঙ্গে প্রায় নিয়ত আমার কথাবার্তা হইয়াছে। স্রোতের সঙ্গে স্রোত যেমন অনায়াসে মেশে তেমনি অশ্ৰান্ত আনন্দে ঠাঁহার চিত্তবেগের টানে আমার চিত্ত ধাবিত হইয়া ১ চীনেম্যানের চিঠি : বঙ্গদর্শন, আষাঢ় ১৩০৯, পৃ. ১৫১-৬২। প্ৰবন্ধটি "মজুমদার লাইব্রেরির সংসৃষ্ট আলোচনা সমিতির বিশেষ অধিবেশনে" রবীন্দ্রনাথ পাঠ করিয়ছিলেন ।