পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

●b"O রবীন্দ্র-রচনাবলী উপরে ঘাসের আন্তরণ যে কী ঘন ও তাহা কী নিবিড় সবুজ তাহা না দেখিলে বিশ্বাস করা যায় না। বাড়িটির ঘরগুলি পরিপটি পরিচ্ছন্ন ; লাইব্রেরি সুপাঠ্য গ্রন্থে পরিপূর্ণ ; ভিতরে বাহিরে GRFA লেশমাত্র অযত্নের চিহ্ন নাই। এখানকার ভদ্র গৃহস্থ-ঘরে এই জিনিসটাই বিশেষ করিয়া আমার মনে লাগিয়াছে। ইহাদের ব্যবহারের আরামের ও গৃহসজ্জার উপকরণ আমাদের চেয়ে অনেক বেশি, অথচ ঘরের প্রত্যেক সামান্য জিনিসটির প্রতি গৃহস্থের চিত্ত সতর্কভাবে জাগ্ৰত আছে। নিজের চারিদিকের প্ৰতি শৈথিল্য যে নিজেরই অবমাননা তাহা ইহারা খুব বুঝে । এই জাগ্ৰত আত্মাদরের ভাবটি ছোটাে বড়ো সকল বিষয়েই কাজ করিতেছে। ইহারা নিজের মনুষ্যগীেরবকে খাটো করিয়া দেখে না। বলিয়াই নিজের ঘরবাড়িকে যেমন সর্বপ্রযত্নে তাহার উপযোগী করিয়া তুলিয়াছে তেমনি নিজের প্রতিবেশকে সমাজকে দেশকে সকল বিষয়ে সকল দিক হইতে সন্মার্জন করিয়া তুলিবার জন্য ইহাদের প্ৰয়াস অহরহ উদ্যত হইয়া রহিয়াছে। ক্রটি জিনিসটাকে ইহারা কোনো কারণেই কোনো জায়গাতেই মাপ করিতে চায় না । বিকালের দিকে আমাকে লইয়া গৃহস্বামী উট্রম সাহেব বেড়াইতে বাহির হইলেন। তখন বৃষ্টি থামিয়াছে, কিন্তু আকাশে মেঘের অবকাশ নাই। এখানকার পুরুষেরা যেমন কালো টুপি মাথায় দিয়া মলিন বর্ণের কোর্তা পরিয়া বেড়ায়, এখানকার দেবতাও সেইরকম অত্যন্ত গভীর ভদ্রবেশে আচ্ছন্ন হইয়া দেখা দিলেন। কিন্তু, এই ঘনগাষ্ঠীর্যের ছায়াতলেও এখানকার পল্লীশ্ৰীীর সৌন্দর্য ঢাকা পড়িল না। গুল্মশ্রেণীর বেড়ার দ্বারা বিভক্ত ঢেউ খেলানো প্রান্তরের প্রগাঢ় শ্যামলিমা দুই চক্ষুকে স্নিগ্ধতায় অভিষিক্ত করিয়া দিল । জায়গাটা পাহাড়ে বটে কিন্তু পাহাড়ের উগ্ৰ বন্ধুরতা কোথাও নাই- আমাদের দেশের রাগিণীতে যেমন সুরের গায়ে সুর মিড়ের টানে ঢলিয়া পড়ে, এখানকার মাটির উচ্ছাসগুলি তেমনি ঢালু হইয়া পরস্পর গায়ে গায়ে মিলিয়া রহিয়াছে ; ধরিত্রীর সুরবাহারে যেন কোন দেবতা নিঃশব্দ রাগিণীতে মেঘমাল্লারের গৎ বাজাইতেছেন। আমাদের দেশের যে-সকল প্রদেশ পার্বত, সেখানকার যেমন একটা উদ্ধত মহিমা আছে। এখানে তাহা দেখা যায় না । চারি দিকে চাহিয়া দেখিলে মনে হয়, বন্য প্রকৃতি এখানে সম্পূর্ণ, পোষ মানিয়াছে। যেন মহাদেবের বাহন বৃষ- শরীরটি নধর চিকুণ, নদীর তর্জনী-সংকেত মানিয়া তাহার পায়ের কাছে শিঙ নামাইয়া শান্ত হইয়া পড়িয়া আছে, প্রভুর তপোবিয়ের ভয়ে হাম্বাধবনিও করিতেছে না । পথে চলিতে চলিতে উট্রম সাহেব একজন পথিকের সঙ্গে কিছু কাজের কথা আলাপ করিয়া লাইলেন। ব্যাপারটা এই- স্থানীয় চাষী গৃহস্থাদিগকে নিজেদের ভিটার চারি দিকে খানিকটা করিয়া বাগান করিতে উৎসাহ দিবার জন্য, ইহারা একটি কমিটি করিয়া উৎকর্ষ অনুসারে পুরস্কারের ব্যবস্থা করিয়াছেন। অল্পদিন হইল পরীক্ষা হইয়া গিয়াছে, তাহাতে এই পথিকটি পুরস্কারের অধিকারী হইয়াছে। উট্রম সাহেব আমাকে কয়েকটি চাষী গৃহন্থের বাড়ি দেখাইতে লইয়া গেলেন। তাহারা প্রত্যেকেই নিজের কুটীরের চারি দিকে বহু যত্নে খানিকটা করিয়া ফুলের ও তরকারির বাগান করিয়াছে। ইহারা সমস্তদিন মাঠের কাজে খাটিয়া সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরিয়া এই বাগানের কাজ করে । এমনি করিয়া গাছপালার প্রতি ইহাদের এমন একটা আনন্দের টান হয় যে, এই অতিরিক্ত পরিশ্রম ইহাদের গায়ে লাগে না । ইহার আর-একটি সুফল এই যে, এই উৎসাহ মদের নেশাকে খেদাইয়া রাখে। বাহিরকে রমণীয় করিয়া তুলিবার এই চেষ্টায় নিজের অন্তরকেও ক্রমশ সৌন্দর্যের সুরে বঁধিয়া তোলা হয়। এখানকার পল্লীবাসীর সঙ্গে উট্রম সাহেবের হিতানুষ্ঠানের সম্বন্ধ আরো নানা দিক হইতে দেখিয়ছি। এইপ্ৰকার মঙ্গলব্লতে-নিয়ত উৎসর্গ করা জীবন যে কী সুন্দর তাহা ইহাকে দেখিয়া অনুভব করিয়াছি। ভগবানের সেবার অমৃতরসে ইহার জীবন পরিপাক মধুর ফলের মতো নক্স হইয়া পড়িয়াছে। ইহার ঘরের মধ্যে ইনি একটি পুণ্যের প্রদীপ জ্বালিয়া রাখিয়াছেন ; অধ্যয়ন ও উপাসনার দ্বারা ইহার গার্হস্থ্য প্রতিদিন ধৌত হইতেছে ; ইহার আতিথ্য যে কিরূপ সহজ ও সুন্দর তাহা আমি ভুলিতে পারিব না। এই-যে এক-একটি করিয়া পাদ্রি কয়েকটি গ্রামের কেন্দ্ৰ হইয়া বসিয়া আছেন, ইহার সার্থকতা এবার