পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VO) যদি তাহারা স্কুলের কারখানার মধ্যে প্রবেশ করিয়া কেবলমাত্র কলের সামগ্ৰী হইয়া বাহির হইয়া যায়, এখানকার সমাজে প্ৰত্যক্ষ মনুষ্যত্বের জন্মস্থানে প্ৰবেশ না করে, তবে বিদেশে আসিয়াও বঞ্চিত হইবে । সীমার সার্থকতা 品 এ কথা মাঝে মাঝে শুনিয়াছি যে, কবিত্বের মধ্যে জীবনের সম্পূর্ণ সার্থকতা নাই। ঈশ্বরের সাধনাকে কাব্যালংকারের ক্ষেত্র হইতে সংসারে কর্মের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত না করিলে তাহা সত্যের দৃঢ়তা F5 제3 R | মাঝে মাঝে অবসাদের দিনে নিজেও এ কথা ভাবিয়ছি। কিন্তু আমি জানি, এরূপ চিন্তা মনের মধ্যে মরীচিকা-বিস্তার মাত্র । মানুষের যে রিপুতাহার কানে মিথ্যামন্ত্র জপ করে, লোভ তাহার মধ্যে অগ্রগণ্য। সে মানুষকে এই কথা বলে, “তুমি যাহা তাহার মধ্যে সত্য নাই, তাহার বাহিরেই সত্য।’ কিন্তু উপনিষৎ বলিয়াছেন ; মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম। কাহারো ধনে লোভ করিয়ো না। অর্থাৎ, তোমার সীমার বাহিরে যাহা আছে তাহার পশ্চাতে চিত্তকে ও চেষ্টাকে ধাবিত করিয়ো না। কেন করিব না। ঐ শ্লোকে সে কথাটাও বলা আছে। উপনিষৎ বলিতেছেন, তিনিই সমস্তকে আচ্ছন্ন করিয়া আছেন ; অতএব, যাহার মধ্যে তিনি আছেন, যাহা তাহার দান, তাহার মধ্যে কোনো অভাবই নাই। নিজের মধ্যে যখন ঐশ্বৰ্যকে উপলব্ধি করি না। তখনই মনে করি, ঐশ্বৰ্য পরের মধ্যেই আছে। কিন্তু, যে দীনতাবশত ঐশ্বৰ্যকে নিজের মধ্যে পাই নাই সেই দীনতাবশতই তাহাকে অন্যত্র পাইবার আশা নাই । সীমা আছে। এ কথা যেমন নিশ্চিত, অসীম আছেন এ কথা তেমনি সত্য। আমরা উভয়কে যখন বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখি তখনই আমরা মায়ার ফাঁদে পড়ি। তখনই আমরা এমন একটা ভুল করিয়া বসি যে, আপনার সীমাকে লঙ্ঘন করিলেই বুঝি আমরা অসীমকে পাইব- যেন আত্মহত্যা করিলেই অমরজীবন পাওয়া যায়। যেন আমি না হইয়া আর-কিছু হইলেই আমি ধন্য হইব । কিন্তু, আমি হওয়াও যা আর-কিছু হওয়া যে তাঁহাই, সে কথা মনে থাকে না। আমার এই আমির মধ্যে যদি ব্যর্থতা থাকে। তবে অন্য কোনো আমিত্ব লাভ করিয়া তাহা হইতে নিষ্কৃতি পাইব না। আমার ঘটের মধ্যে ছিদ্র থাকাতে যদি জল বাহির হইয়া যায়, তবে সে জলের দোষ নহে। দুধ ঢালিলেও সেই দশা হইবে, এবং মধু ঢালিলেও তথৈবচ | জীবনে একটিমাত্র কথা ভাবিবার আছে যে, আমি সত্য হইব । আমি কবি হইব কি কমী হইব। কি আর-কিছু হইব, সেটা নিতান্তই ব্যর্থচিন্তা। সত্য হইব। এ কথার অর্থই এই কোথায় আমার সীমা সেটা , নিশ্চিতরূপে অবধারণ করিব। দুরাশার প্রলোভনে সেইটো সম্বন্ধে যদি মন স্থির না করি, তবে সত্য ব্যবহার হইতে ভ্ৰষ্ট হইব । অহংকারকে যে আমরা রিপু বলি, লোভকে যে আমরা রিপু বলি, তাহার কারণ এই--আমাদের সীমা সম্বন্ধে সে আমাদিগকে ঠিকটা বুঝিতে দেয় না। সে আমাদের আপনাকে জানার তপস্যায় বাধা দিয়া কেবলই বলিতে থাকে, “তুমি যাহা তুমি তাহার চেয়ে আরো বেশি অথবা অন্য কিছু।” ইহা হইতে পৃথিবীতে যত দুঃখ, যত বিদ্বেষ, যত কড়াকড়ি-হানাহানির সৃষ্টি হইতে থাকে। এমন আর কিছুতেই না । যাহা মিথ্যা তাহঁকেই গায়ের জোরে সত্য করিতে গিয়া পৃথিবীতে যতি-কিছু অমঙ্গলের উৎপত্তি श । সীমাহীনতার প্রতি আমাদের একটা প্রবল আকর্ষণ আছে, সেই আকর্ষণই আমাদের জীবনকে গতিদান করে। সেই আকর্ষণকে অবহেলা করিয়া নিশ্চেষ্ট হইয়া বসিয়া থাকিলে মঙ্গল নাই। ভূমাকে আমাদের পাইতেই হইবে, সেই পাওয়াতেই আমাদের সুখ ।