পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী কিন্তু, নিজের সীমার মধ্যেই সেই অসীমকে পাইতে হইবে, ইহা ছাড়া গতি নাই। সীমার মধ্যে অসীমকে ধরে না, এই ভ্ৰান্ত বিশ্বাসে আমরা অসীমকে খর্ব করিয়া থাকি। এ কথা সত্য, এক সীমার মধ্যে অন্য সীমাবদ্ধ পদার্থ সম্পূর্ণ স্থান পায় না। কিন্তু, অসীমের সম্বন্ধে সে কথা খাটে না। তিনি একটি বালুকণার মধ্যেও অসীম। এইজন্য একটি বালুকণাকেও যখন সম্পূর্ণরূপে সর্বতোভাবে আয়ত্ত করিতে যাই তখন দেখি, বিশ্বকে আয়ত্ত না করিলে তাহাকে পাইবার জো নাই ; কারণ, এক জায়গায় নিখিলের সঙ্গে সে অবিচ্ছেদ্য, তাহার এমন একটা দিক আছে যে দিকটাতে কিছুতেই তাহাকে শেষ করা যায় না । আমরা নিজের সীমার মধ্যেই অসীমের প্রকাশকে উপলব্ধি করিব, ইহাই আমাদের সাধনা। কারণ, সেই অসীমেরই আনন্দ আমার মধ্যে সীমা রচনা করিয়াছেন ; সেই সীমার মধ্যেই তাহার বিলাস, তাহার বিহার। র্তাহার সেই নিকেতনকে ভাঙিয়া ফেলিয়া তীহাকে বেশি করিয়া পাইব, এমন কথা মনে করাই ভুল । গোলাপ-ফুলের মধ্যে সৌন্দর্যের একটি অসীমতা আছে তাহার কারণ, সে সম্পূর্ণরূপেই গোলাপ ফুল- সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ, কোনো অনির্দিষ্টতা নাই। এইজন্যই গোলাপ-ফুলের মধ্যে এমন একটি আবির্ভাব সুস্পষ্ট হইয়াছে যাহা চন্দ্ৰসূর্যের মধ্যে, যাহা জগতের সমস্ত সুন্দরের মধ্যে। সে সুনিশ্চিত সত্যরূপে গোলাপ-ফুল বলিয়াই সমস্ত জগতের সঙ্গে তাহার আত্মীয়তা সত্য। বস্তুত অস্পষ্টতই ব্যর্থতা ; সুতরাং সেইখানেই ভূমীর প্রকাশ প্রতিহত, ভূমার আনন্দ-প্রচ্ছন্ন। তাহার আনন্দ রূপগ্রহণের দ্বারাই সার্থক। অসীম যিনি তিনি সীমার মধ্যেই সত্য, সীমার মধ্যেই সুন্দর। এইজন্য জগৎ সৃষ্টির ইতিহাসে রূপের বিকাশ কেবলই সুব্যক্ত হইয়া উঠিতেছে ; সীমা হইতে সীমার অভিমুখে চলিয়াছে অসীমের অভিসারযাত্রা। কুঁড়ি হইতে ফুল, ফুল হইতে ফল, কেবলই রূপ হইতে दख्*७: प्रा° | এইজন্যই আপনাকে স্পষ্ট করিয়া পাওয়াই মানুষের সাধনা। স্পষ্ট করিয়া পাওয়ার অর্থই সীমাবদ্ধ করিয়া পাওয়া । যখনই নানা পথে নানা দুরাশার বিক্ষিপ্ততা হইতে নিজেকে সংহত করিয়া সীমার মধ্যে আপনাকে স্পষ্ট করিয়া দাড় করানো যায়, তখনই জীবনের সার্থকতাকে লাভ করি । সীতার যতক্ষণ না শিখি ততক্ষণ এলোমেলো হাত পা ছোড়া চলে । ভালো সাতার যেমনি শিখি অমনি আমাদের চেষ্টা সীমাবদ্ধ হইয়া আসে এবং তাঁহা সুন্দর হইয়া প্ৰকাশ পায়। পাখি যখন ওড়ে তখন সুন্দর দেখিতে হয়, কারণ, তাহার ওড়ার মধ্যে দ্বিধা নাই, তাহা সুনিয়ত অৰ্থাৎ তাহা আপনার নিশ্চিত সীমাকে পাইয়াছে। এই সীমাকে পাওয়াই সৃষ্টি অর্থাৎ সীতা ; এবং সীমার দ্বারা অসীমকে পাওয়াই সৌন্দৰ্য অর্থাৎ আনন্দ । সীমা হইতে ভ্ৰষ্ট হওয়াই কদৰ্যতা, তাহাই নিরানন্দ, তাহাই বিনাশ । কাব্যালংকার তখনই ব্যর্থ যখনই তাহা মিথ্যা, অর্থাৎ যখনই তাহা আপনার সীমাকে না পাইয়া আর-কিছু হইবার চেষ্টা করিতেছে। তখনই সে ভান করে ; তখনই সে ছোটোকে বড়ো করিয়া দেখায়, বড়োকে ছোটাে করিয়া আনে। তখনই তাহা কথার কথামাত্র, তাহা সৃষ্টি নহে। কিন্তু, কবি যেখানে সত্য, যেখানে সে আপনার অসীমকে আপনার সীমার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে, আপনার আনন্দকে আপনার শক্তির মধ্যে মূর্তিদান করে, সেখানে সে সৃষ্টি করে। জগতের সকল সৃষ্টির মধ্যেই তাহার স্থান। সত্যকর্মী যে কর্মের সৃষ্টি করে, সত্যসাধক যে জীবনের সৃষ্টি করে, সকলেরই সঙ্গে এক পঙুক্তিতে আসন লইবার অধিকার তাহার। কার্লাইল প্রভৃতি বাক্যরচকেরা বাক্যের চেয়ে কাজকে যে বড়ো স্থান দিয়াছেন, ভাবিয়া দেখিলে বুঝা যায় তাহার অর্থ এই যে, তাহারা মিথ্যা বাক্যের চেয়ে সত্যু কাজকে গীেরব দান করিতে চান। সেইসঙ্গে এ কথাও বলা উচিত, মিথ্যা কাজের চেয়ে সত্য বাক্য অনেক বড়ো । আসল কথাই এই সত্য যে-কোনো আকারেই প্রকাশ পাক-না কেন তাহা একই ; তাহাই মানুষের চিরসম্পদ । যেমন টাকা যেখানে সত্য, অর্থাৎ শক্তি যেখানে টাকা-আকারে প্রকাশ পায়, সেখানে সে টাকা কেবলমাত্র টাকা নিছে, তাহ অন্নও বটে, বিত্রও বটে, শিক্ষাও বটে, স্বাস্থ্যও বটে ; তখন সে টাকা