পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

a8 রবীন্দ্র-রচনাবলী সীমা ও অসীমতা ধর্ম শব্দের গোড়াকার অর্থ যাহা ধরিয়া রাখে। religion শব্দের বুৎপত্তি আলোচনা করিলে বুঝা যায় তাহারও মূল অর্থ যাহা বাধিয়া তোলে। অতএব, এক দিক দিয়া দেখিলে দেখা যায়, মানুষ ধর্মকে বন্ধন বলিয়া স্বীকার করিয়াছে। ধর্মই মানুষের চেষ্টার ক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ করিয়া সংকীর্ণ করিয়া তুলিয়াছে। এই বন্ধনকে স্বীকার করা এই সীমাকে লাভ করাই মানুষের চরম সাধনা ৷ কেননা সীমাই সৃষ্টি। সীমারেখা যতই সুবিহিত সুস্পষ্ট হয় সৃষ্টি ততই সত্য ও সুন্দর হইতে থাকে। আনন্দের স্বভাবই এই সীমাকে উদভিন্ন করিয়া তোলা। বিধাতার আনন্দ বিধানের সীমায় সমস্ত সৃষ্টিকে বধিয়া তুলিতেছে। কমীির আনন্দ, কবির আনন্দ, শিল্পীর আনন্দ- কেবলই ক্ষুটতররূপে সীমা রচনা করিতেছে। ধর্মও মানুষের মনুষ্যত্বকে তাহার সত্য সীমার মধ্যে ফুটতর করিয়া তুলিবার শক্তি। সেই সীমাটি যতই সহজ হয়, যতই সুব্যক্ত হয়, ততই তাহা সুন্দর হইয়া উঠিতে থাকে। মানুষ ততই শক্তি ও স্বাস্থ্য ও ঐশ্বৰ্য লাভ করে, মানুষের মধ্যে আনন্দ ততই প্ৰকাশমান হইয়া উঠে । ধর্মের সাহায্যে মানুষ আপনার সীমা খুঁজিতেছে, অথচ-সেই ধর্মের সাহায্যেই মানুষ আপনার অসীমকে খুজিতেছে। ইহাই আশ্চর্য। বিশ্বসংসারে সমস্ত পূর্ণতার মূলেই আমরা এই দ্বন্দ্ব দেখিতে পাই । যাহা ছোটাে করে তাঁহাই বড়ো করে, যাহা পৃথক করিয়া দেয় তাহাঁই এক করিয়া আনে, যাহা বঁধে তাঁহাই মুক্তিদান করে ; অসীমই সীমাকে সৃষ্টি করে এবং সীমাই অসীমকে প্রকাশ করিতে থাকে। বস্তুত, এই দ্বন্দ্ব যেখানেই সম্পূর্ণরূপে একত্র হইয়া মিলিয়াছে সেইখানেই পূর্ণতা। যেখানে তাঁহাদের বিচ্ছেদ ঘটিয়া একটা দিকই প্রবল হইয়া ওঠে সেইখানেই যত অমঙ্গল । অসীম যেখানে সীমাকে ব্যক্তি করে না সেখানে তাহা শূন্য, সীমা যেখানে অসীমকে নির্দেশ করে না সেখানে তাহা নিরর্থক । মুক্তি যেখানে বন্ধনকে অস্বীকার করে সেখানে তাহা উন্মত্ততা, বন্ধন যেখানে মুক্তিকে মানে না। সেখানে তাহা উৎপীড়ন । আমাদের দেশে মায়াবাদে সমস্ত সীমাকে মায়া বলিয়াছে। কিন্তু, আসল কথা এই, অসীম হইতে বিযুক্ত সীমাই মায়া। তেমনি ইহাও সত্য, সীমা হইতে বিযুক্ত অসীমও মায়া । যে গান আপনার সুরের সীমাকে সম্পূর্ণরূপে পাইয়াছে সে গান কেবলমাত্র সুরসমষ্টিকে প্রকাশ করে না- সে আপনার নিয়মের দ্বারাই আনন্দকে, সীমার দ্বারাই সীমার চেয়ে বড়োকে ব্যক্ত করে। গোলাপ-ফুল সম্পূর্ণরূপে আপনার সীমাকে লাভ করিয়াছে বলিয়াই সেই সীমার দ্বারা সে একটি অসীম সৌন্দর্যকে প্রকাশ করিতে থাকে। এই সীমার দ্বারা গোলাপ-ফুল প্রকৃতিরাজ্যে একটি বস্তুবিশেষ, কিন্তু ভােবরাজ্যে আনন্দ। এই সীমাই তাহাকে এক দিকে বধিয়াছে, আর-এক দিকে ছাড়িয়ছে। এইজন্যই দেখিতে পাই, মানুষের সকল শিক্ষারই মূলেসংযমের সাধনা। মানুষ আপনার চেষ্টাকে সংযত করিতে শিখিলেই তবে চলিতে পারে, ভাবনাকে বধিতে পারিলে তবেই ভাবিতে পারে। সেই কারুকরই সুনিপূণ যে লোক কর্মের সীমাকে অর্থাৎ নিয়মকে সম্পূর্ণরূপে জানিয়াছে এবং মানিয়ছে। সেই লোকই নিজের জীবনকে সুন্দর করিতে পারিয়াছে যে তাহাকে সংযত করিয়াছে। এবং সতী স্ত্রী যেমন সতীত্বের সংযমের দ্বারাই আপনার প্রেমের পূর্ণ চরিতার্থতাকে লাভ করে, তেমনি যে মানুষ পবিত্ৰচিত্ত, অর্থাৎ যে আপনার ইচ্ছাকে সত্য সীমায় বাধিয়াছে, সেই তাহাকে পায় যিনি সাধনার চরম ফল, যিনি পরম আনন্দস্বরূপ। এই ধর্মকে বন্ধনরপে দুঃখরূপে স্বীকার করা হইয়াছে ; বলা হইয়াছে, ধর্মের পথ শাণিত ক্ষুরধারের মতো দুৰ্গম। সে পথ যদি অসীমবিস্তৃত হইত। তবে সকল মানুষই যেমন-তেমন করিয়া চলিতে পরিত, কাহারও কোথাও কোনাে বাধাবিপত্তি থাকিিত না। কিন্তু, সে পথ সুনিশ্চিত নিয়মের সীমায় দৃঢুরাণে আবদ্ধ, এইজন্যই তাহা দুৰ্গম। ধ্রুবরূপে এই সীমা-অনুসরণে কঠিন দুঃখকে মানুষের গ্রহণ করিতেই