পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

AYVe রবীন্দ্র-রচনাবলী গলা ভাত উপোসের পরে ছিল অমৃত । । জ্বরে ভোগা কাকে বলে মনে পড়ে না । ম্যালেরিয়া বলে শব্দটা শোনাই ছিল না । ওয়াক-ধরানো ওষুধের রাজা ছিল ঐ তেলটা, কিন্তু মনে পড়ে না। কুইনীন। গায়ে ফোঁড়াকাটা চুরির আঁচড় পড়ে নি কোনোদিন। হাম বা জলবসন্তু কাকে বলে আজ পর্যন্ত জানি নে। শরীরটা ছিল একওঁয়ে রকমের ভালো । মায়েরা যদি ছেলেদের শরীর এতটা নীরুগী রাখতে চান যাতে মাস্টারের হাত এড়াতে না পারে তা হলে ব্ৰজেশ্বরের মতো চাকর খুঁজে বের করবেন। খাবার-খরচার সঙ্গে সঙ্গেই সে বঁাচাবে ডাক্তার-খরচা ; বিশেষ করে এই কলের জাতার ময়দা আর এই ভেজাল দেওয়া ঘি-তেলের দিনে । একটা কথা মনে রাখা দরকার, তখনো বাজারে চকোলেট দেখা দেয় নি। ছিল এক পয়সা দামের গোলাপি-ব্লেউড়ি । গোলাপি গন্ধের আমেজ দেওয়া এই তিলে-ঢাকা চিনির ডালা আজও ছেলেদের পকেট চটচটে করে তোলে কি না জানি নে- নিশ্চয়ই এখনকার মানী লোকের ঘর থেকে লজ্জায় দৌড় মেরেছে। সেই ভাজা মসলার ঠোঙা গেল কোথায় । আর সেই সন্তা দামের তিলে গজা ? সে কি এখনো টিকে আছে । না থাকে তো তাকে ফিরিয়ে আনার দরকার নেই। ব্ৰজেশ্বরের কাছে সন্ধেবেলায় দিনে দিনে শুনেছি কৃত্তিবাসের সাতকাণ্ড রামায়ণটা। সেই পড়ার মাঝে মাঝে এসে পড়ত কিশোরী চাটুজ্যে । সমস্ত রামায়ণের পঁাচালি ছিল সুর-সমেত তার মুখস্থ। সে হঠাৎ আসন দখল করে কৃত্তিবাসকে ছাপিয়ে দিয়ে হু হু করে আউড়িয়ে যেত তার পাচলির পালা । ‘ওরে রে লক্ষণ, এ কী অলক্ষণ, বিপদ ঘটেছে বিলক্ষণ। তার মুখে হাসি, মাথায় টাক ঝক ঝক করছে, গলা দিয়ে ছড়া-কাটা লাইনের ঝরনা সুর বাজিয়ে চলছে, পদে পদে শব্দের মিলগুলো বেজে ওঠে যেন জলের নিচেকার নুড়ির আওয়াজ । সেইসঙ্গে চলত। তার হােত পা নেড়ে ভাৰ-বাতিলানো। কিশোরী চাটুজ্যের সব চেয়ে বড়ো আপসোস ছিল এই যে, দাদাভাই অর্থাৎ কিনা আমি, এমন গলা নিয়ে পাচলির দলে ভর্তি হতে পারলুম না। পারলে দেশে যা-হয় একটা নাম থাকত । রাত হয়ে আসত, মাদুর-পাতা বৈঠক যেত ভেঙে। ভূতের ভয় শিরদাঁড়ার উপর চাপিয়ে চলে যৌতুম বাড়ির ভিতরে মায়ের ঘরে । মা তখন তার খুড়িকে নিয়ে তাস খেলছেন । পংখের-কাজ-করা ঘর হাতির দাঁতের মতো চকচকে, মন্ত তক্তপোশের উপর জাজিম পাতা। এমন উৎপাত বাধিয়ে দিতুম যে তিনি হাতের খেলা ফেলে দিয়ে বলতেন, “জ্বালাতন করলে, যাও খুড়ি, ওদের গল্প শোনাও গে।” আমরা বাইরের বারান্দায় ঘটির জলে পা ধুয়ে দিদিমাকে টেনে নিয়ে বিছানায় উঠাতুম। সেখানে শুরু হত দৈত্যপুরী থেকে রাজকন্যার ঘুম ভাঙিয়ে আনার পালা । মাঝখানে আমারই ঘুম ভাঙায় কে । রাতের প্রথম পহরে শেয়াল উঠিত ডেকে । তখনো শেয়াল-ডাকা রাত কলকাতার কোনো কোনো পুরোনো বাড়ির ভিতের নীচে ফুকরে উঠত। আমরা যখন ছোটাে ছিলুম। তখন সন্ধ্যাবেলায় কলকাতা শহর এখনকার মতো এত বেশি সজাগ ছিল না। এখনকার কালে সূর্যের আলোর দিনটা যেমনি ফুরিয়েছে অমনি শুরু হয়েছে বিজলি আলোর দিন। সে সময়টাতে শহরে কাজ কম কিন্তু বিশ্রাম নেই। উনুনে যেন জ্বলা কাঠ নিভেছে তবু কয়লায় রয়েছে আগুন । তেলকল চলে না, স্টিমারের বাঁশি থেমে থাকে, কারখানাঘর থেকে মজুরের দল বেরিয়ে গেছে, পাটর-গািট টানা গাড়ির মোষগুলো গেছে টিনের চালের নীচে শহুরে গোষ্ঠে । সমস্তদিন যে শহরের মাথা ছিল নানা চিন্তায় তোতে আগুন , এখনো তার নাড়িগুলো যেন দব দািব করছে। রাস্তার দুধারে দোকানগুলোতে কেনাবেচা তেমনি আছে, কেবল সামান্য কিছু ছাইচাপা । স্কুলে গােন্ধনীতে দিতে হওয়াগড়ি ছুটজেল দিকে তাদের দৌড়ের পিছনে গরজের আমাদের সেকালে দিন ফুরলে কাজকর্মের বাড়তি ভাগ যেন কালো কম্বল মুড়ি দিয়ে চুপচাপ শুয়ে