পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

GRIMSKIM অতি পুরোনো কালের ভুলে যাওয়া খবরের আমেজ আসে এমন লাইনও পাওয়া যায়। যেমন এক যে ছিল কুকুর-চাটা শেয়ালকাটার বন কোিট করলে সিংহাসন । এখনকার নিয়ম হচ্ছে প্ৰথমে হরমোনিয়মে সুর লাগিয়ে সা রে গা মা সাধানো, তার পরে হালকা গোছের হিন্দি গান ধরিয়ে দেওয়া। তখন আমাদের পড়াশুনোর যিনি তদারক করতেন। তিনি বুঝেছিলেন, ছেলেমানুষ ছেলেদের মনের আপনি জিনিস, আর ঐ হালকা বাংলা ভাষা হিন্দি বুলির চেয়ে মনের মধ্যে সহজে জায়গা করে নেয় । তা ছাড়া, এ ছন্দের দিশি তাল বঁয়া-তবলার বোলের তোয়াক্কা রাখে না। আপনা-আপনি নাড়ীতে নাচতে থাকে। শিশুদের মন-ভোলানো প্ৰথম সাহিত্য শেখানো মায়ের মুখের ছড়া দিয়ে, শিশুদের মন-ভোলানো গান শেখানোর শুরু সেই ছড়ায়- এইটে আমাদের উপর দিয়ে পরখ করানো হয়েছিল । তখন হারমোনিয়ম আসে নি এ দেশের গানের জাত মারতে । কঁধের উপর তাম্বুরা তুলে গান অভ্যোস করেছি। কল-টেপা সুরের গোলামি করি নি। আমার দোষ হচ্ছে, শেখবার পথে কিছুতেই আমাকে বেশি দিন চালাতে পারে নি। ইচ্ছেমত কুড়িয়ে-বাড়িয়ে যা পেয়েছি বুলি ভর্তি করেছি। তাই দিয়েই। মন দিয়ে শেখা। যদি আমার ধাতে থাকত তা হলে এখনকার দিনের ওস্তাদরা আমাকে তাচ্ছিল্য করতে পারত না। কেননা সুযোগ ছিল বিতর। যে কয়দিন আমাদের শিক্ষা দেবার কর্তা ছিলেন। সেজদাদা ততদিন বিষ্ণুর কাছে আনমনাভাবে ব্ৰহ্মসংগীত আউড়েছি। কখনো কখনো যখন মন আপনা হতে লেগেছে তখন গান আদায় করেছি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে। সেজদাদা বেহাগে, আওড়াচ্ছেন ‘অতি-গজ-গামিনী রে, আমি লুকিয়ে মনের মধ্যে তার ছাপ তুলে নিচ্ছি। সন্ধেবেলায় মাকে সেই গান শুনিয়ে অবাক করা খুব সহজ কাজ ছিল। আমাদের বাড়ির বন্ধু শ্ৰীকণ্ঠবাবুদিনরাত গানের মধ্যে তলিয়ে থাকতেন। বারান্দায় বসে বসে চামেলির তেল মেখে স্নান করতেন, হাতে থাকত গুড়গুড়ি, অম্বুরি তামাকের গন্ধ উঠতি আকাশে, গুন গুন গান চলত, ছেলেদের টেনে রাখতেন চার দিকে । তিনি তো গান শেখাতেন না, গান তিনি দিতেন ; কখন তুলে নিতুম জানতে পারতুম না । ফুর্তি যখন রাখতে পারতেন না। দাড়িয়ে উঠতেন, নেচে নোচে বাজাতে থাকতেন সেতার, হাসিতে বড়ো বড়ো চোখ জ্বল জ্বল করত, গান ধরতেন- ময় ছেড়ে ব্ৰজকী বাসরী। সঙ্গে সঙ্গে আমিও না গাইলে ছাড়তেন না। তখনকার আতিথ্য ছিল খোলা দরজার । চেনাশোনার খোজখবর নেবার বিশেষ দরকার ছিল না । যারা যখন এসে পড়ত তাদের শোবার জায়গায় মিলত, অল্পের থালাও আসত যথানিয়মে। সেই রকমের অচেনা অতিথি একদিন লেপ-মোড়া তাম্বুরা কঁাখে করে তঁর পুঁটুলি খুলে বসবার ঘরের এক পাশে পা ছড়িয়ে দিলেন। কানাই ইকোবরাদার যথারীতি তার হাতে দিলে ইকো তুলে। সেকালে ছিল অতিথির জন্যে এই যেমন তামাক তেমনি পান। তখনকার দিনে বাড়ি-ভিতরে মেয়েদের সকাল বেলাকার কাজ ছিল ঐ- পান সাজতে হত রাশি রাশি, বাইরের ঘরে যারা আসত তাদের উদ্দেশে। চাটুপটু পানে চুপ লাগিয়ে, কাঠি দিয়ে খয়ের লেপে, ঠিকমত মসলা ভরে, লিঙ্গ দিয়ে মুড়ে সেগুলো বোঝাই হতে থাকত পিতলের গামলায় ; উপরে পড়ত খয়েরের ছোপলাগী ভিজে ন্যাকড়ার ঢাকা। ওদিকে বাইরে সিঁড়ির নীচের ঘরটাতে চলত তামাক সাজার ধুম। মাটির গামলায় ছাই-ঢাকা গুল, আলবােলার নলগুলো ঝুলছে নাগলোকের সাপের মতো, তাদের নাড়ীর মধ্যে গােলাপ-জলের গন্ধ। বাড়িতে ধারা আসতেন সিড়ি দিয়ে ওঠবার মুখে তঁরা গৃহছের প্রথম ‘আসুন মশায় ডাক পেতেন এই অম্বুরি তামাকের গন্ধে। তখন এই একটা বাধা নিয়ম ছিল মানুষকে মেনে নেওয়ার। সেই ভরপুর পানের গামলা অনেক দিন হল সরে পড়েছে, আর সেই ইকোবরাদার জাতটা সাজ খুলে ফেলে ময়রার দোকানে তিন দিনের বাসি সন্দেশ চটকে চটকে মাখতে লেগেছে।