পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Se রবীন্দ্র-রচনাবলী হঠাৎ তাদের ইক পীেছত যেখানে বালিশের উপর খোলা চুল এলিয়ে দিয়ে শুয়ে থাকত বাড়ির বউ, দাসী ডেকে নিয়ে আসত। ভিতরে, বুড়ো চুড়িওয়ালা কচি হাত টিপে টিপে পরিয়ে দিত পছন্দমত বেলোয়ারি চুড়ি। সেদিনকার সেই বউ আজকের দিনে এখনো বউয়ের পদ পায় নি, সেকেন্দ্ৰ ক্লাসে সে পড়া মুখস্থ করছে। আর সেই চুড়িওয়ালা হয়তো আজ সেই গলিতেই বেড়াচ্ছে রিকশা ঠেলে । ছদটা ছিল আমার কেতাবে-পড়া মরুভূমি, ধুধু করছে। চার দিক । গরম বাতাস হু হু করে ছুটে যাচ্ছে ধুলো উড়িয়ে, আকাশের নীল রঙ এসেছে ফিকে হয়ে । এই ছাদের মরুভূমিতে তখন একটা ওয়েসিস দেখা দিয়েছিল। আজকাল উপরের তলায় কলের জলের নাগাল নেই। তখন তেতালার ঘরেও তার দৌড় ছিল । লুকিয়ে-ঢোকা নাবার ঘর, তাকে যেন বাংলা দেশের শিশু লিভিংস্টেন এইমাত্র খুঁজে বের করলে। কল দিতুম খুলে, ধারাজিল পড়ত সকল গায়ে। বিছানার একখানা চাদর নিয়ে গা মুছে সহজ মানুষ হয়ে বসতুম। ছুটির দিনটা দেখতে দেখতে শেষের দিকে এসে পৌছল। নীচের দেউড়ির ঘণ্টায় বাজল চারটি । রবিবারের বিকেল বেলায় আকাশটা বিশ্ৰী রকমের মুখ বিগড়ে আছে। আসছে-সোমবারের হা-করা মুখের গ্ৰহণ-ব্লাগানো ছায়া তাকে গিলতে শুরু করেছে। নীচে এতক্ষণে পাহারা-এড়ানো ছেলের খোজ 9 R এখন জলখাবারের সময় । এইটে ছিল ব্ৰজেশ্বরের একটা লালচিহ্ন-দেওয়া দিনের ভাগ । জলখাবারের বাজার করা ছিল তারই জিন্মায়। তখনকার দিনে দোকানিরা ঘিয়ের দামে শতকরা ত্রিশ-চল্লিশ টাকা হারে মুনফা রাখত না, গন্ধে স্বাদে জলখাবার তখনো বিষিয়ে ওঠে নি। যদি জুটে যেত কচুরি সিঙাড়া, এমনকি, আলুর দম, সেটা মুখে পুরতে সময় লাগত না । কিন্তু যথাসময়ে ব্ৰজেশ্বর যখন তার বঁাকা ঘাড় আরো বাকিয়ে বলত, “দেখো বাবু আজ কী এনেছি, প্রায় দেখা যেত। কাগজের ঠোঙায় চীনেবাদাম-ভাজা ! সেটাতে আমাদের যে রুচি ছিল না তা নয়, কিন্তু ওর দরের মধ্যেই ছিল ওর আদর। কোনোদিন টু শব্দ করি নি ; এমন-কি, যেদিন তালপাতার ঠোঙা থেকে বেরাত তিলেগজা সেদিনও না । দিনের আলো আসছে ঘোলা হয়ে । মন খারাপ নিয়ে একবার ছাদটা ঘুরে আসা গেল, নীচের দিকে দেখলুম তাকিয়ে- পুকুর থেকে পাতিহাসগুলো উঠে গিয়েছে। লোকজনের আনাগোনা আরম্ভ হয়েছে ঘাটে, বটগাছের ছায়া পড়েছে অর্ধেক পুকুর জুড়ে, রাস্তা থেকে জুড়িগাড়ির সইসের ইকি শোনা यg । ܘܬ দিনগুলো এমনি চলে যায় একটানা । দিনের মাঝখানটা ইস্কুল নেয় খাবলিয়ে, সকালে বিকেলে ছিটিকিয়ে পড়ে তারই বাড়তির ভাগ ।। ঘরে ঢুকতেই ক্লাসের বেঞ্চি-টেবিলগুলো মনের মধ্যে যেন শুকনো কনুইয়ের ওঁতে মারে। রোজই তাদের একই আড়ষ্ট চেহারা। সন্ধেবেলায় ফিরে যৌতুম বাড়িতে। ইস্কুলঘরে তেলের বাতিটা তুলে ধরেছে। পরদিনের পড়া তৈরি-পথের সিগনাল। এক-একদিন বাড়ির আঙিনায় আসে। ভালুক-নাচওয়ালা। আসে সাপুড়ে সাপ খেলাতে । এক-একদিন আসে ভোজবাজিওয়ালা, একটু দেয় নতুনের আমেজ । আমাদের চিৎপুর রোডে। আজ আর ওদের ডুগডুগি বাজে না। সিনেমাকে দূর থেকে সেলাম করে তারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। শুকনো পাতার সঙ্গে এক জাতের ফড়িঙ যেমন বেমালুম রঙ মিলিয়ে থাকে, আমার প্রাণটা তেমনি শুকনো দিনের সঙ্গে ফ্যাকাশে হয়ে মিলিয়ে থাকত । তখন খেলা ছিল সামান্য কয়েক রকমের । ছিল মার্বেল, ছিল যাকে বলে ব্যাটবল-ক্রিকেটের অত্যন্ত দূর কুটুম্বা। আর ছিল লাঠিম-ঘোরানো, ঘুড়ি-ওড়ানো। শহরে ছেলেদের খেলা সবই ছিল