পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(MIRV পেরিয়ে চলে যেতেন। অনেক দূর পর্যন্ত। তার দেখাদেখি সীতার আমরাও শিখেছি ছেলেবেলা থেকে। শেখা শুরু করেছিলুম নিজে নিজেই। পায়জামা ভিজিয়ে নিয়ে টেনে টেনে ভরে তুলতুমি বাতাসে। জলে নামলেই সেটা কোমােরর চার দিকে হাওয়ার কোমরবন্দর মতো ফুলে উঠত। তার পরে আর ডোববার জো থাকত না। বড়োবয়সে যখন শিলাইদহের চরে থাকতুম তখন একবার সাতার দিয়ে পদ্মা পেরিয়েছিলুম। কথাটা শুনতে যতটা তাক লাগানো আসলে ততটা নয়। মাঝে মাঝে চড়া-পড়া সেই পদ্মার টান ছিল না। তাকে সমীহ করবার মতো; তবু ডাঙার লোকের কাছে ভয়-লাগানো গল্পটা শোনাবার মতো বটে, শুনিয়েওছি অনেকবার । ছেলেবেলায় যখন গিয়েছি। ড্যালহৌসি পাহাড়ে, পিতৃদেব আমাকে এক-একা ঘুরে বেড়াতে কখনো মানা করেন নি। পায়ে-চলা রান্তায় আমি ফলাওয়ালা লাঠি হাতে এক পাহাড় থেকে আর-এক পাহাড়ে উঠে যৌতুম। তার সকলের চেয়ে মজা ছিল মনে মনে ভয় বানিয়ে তোলা । একদিন ওৎরাই পথে যেতে যেতে পা পড়েছিল গাছের তলায় রাশি-করা শুকনো পাতার উপর। পা একটু হড়কে যেতেই লাঠি দিয়ে ঠেকিয়ে দিলুম। কিন্তু না ঠেকাতেও তো পারতুম । ঢালু পাহাড়ে গড়াতে গড়াতে অনেকদূর নীচে ঝরনার মধ্যে পড়তে কতক্ষণ লাগত। কী যে হতে পারত সেটা এতখানি করে মা'র কাছে বলেছি। তা ছাড়া ঘুন পাইনের বনে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ ভালুকের সঙ্গে দেখা হলেও হতে পারত, এও একটা শোনাবার মতো জিনিস ছিল বটে। ঘটবার মতো কিছুই ঘটে নি, কাজেই অঘটন সব জমিয়েছিলুম মনে । আমার সাতার দিয়ে পদ্মা পার হওয়ার গল্পও এ-সব গল্পের থেকে খুব বেশি তফাত নয় । সতেরো বছরে পড়লুম। যখন, ভারতীর সম্পাদক বৈঠক থেকে আমাকে সরে যেতে হল। এই সময়ে আমার বিলেত যাওয়া ঠিক হয়েছে। আর সেইসঙ্গে পরামর্শ হল, জাহাজে চড়বার আগে মেজদাদার সঙ্গে গিয়ে আমাকে বিলিতি চালচলনের গোড়াপত্তন করে নিতে হবে । তিনি তখন জজিয়তি করছেন আমেদাবাদে ; মেজবউঠাকরুন। আর তার ছেলেমেয়ে আছেন ইংলন্ডে, ফলো নিয়ে মেজদাদা তাদের সঙ্গে যোগ দেবেন। এই অপেক্ষায় । শিকড়সুদ্ধ আমাকে উপড়ে নিয়ে আসা হল এক খেত থেকে আর-এক খেতে । নতুন আবহাওয়ার সঙ্গে বোঝাপড়া শুরু হল। গোড়াতে সব-তাতেই খটকা দিতে লািগলা লজা। নতুন লোকের সঙ্গে আলাপে নিজের মােনরক্ষা করব কী করে এই ছিল ভাবনা। যে অচেনা সংসারের সঙ্গে মাখমাখিও সহজ ছিল না, আর পথ ছিল না যাকে এড়িয়ে যাওয়ার, আমার মতো ছেলের মন সেখানে কেবলই ইচটি খেয়ে মরত। আমেদাবাদে একটা পুরনো ইতিহাসের ছবির মধ্যে আমার মন উড়ে বেড়াতে লাগল। জজের বাসা ছিল শাহিবাগে, বাদশাহি আমলের রাজবাড়িতে । দিনের বেলায় মেজদাদা চলে যেতেন। কাজে ; বড়ো বড়ো ফাকা ঘর স্থা স্থা করছে, সমস্ত দিন ভূতে-পাওয়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। সামনে প্ৰকাণ্ড চাতাল, সেখান থেকে দেখা যেত সবরমতী নদী ইটুজল লুটিয়ে নিয়ে ঐকেবেঁকে চলেছে বালির মধ্যে । চাতালটার কোথাও কোথাও চৌবাচ্ছার পাথরের গাথনিতে যেন খবর জমা হয়ে আছে বেগমদের স্নানের আমির আনার । কলকাতায় আমরা মানুষ, সেখানে ইতিহাসের মাথাতোলা চেহারা কোথাও দেখি নি। আমাদের চাহনি খুব কাছের দিকের বেঁটে সময়টাতেই বাধা । আমেদাবাদে এসে এই প্রথম দেখলুম। চলতি ইতিহাস থেমে গিয়েছে, দেখা যাচ্ছে তার পিছনে-ফেরা বড়ো ঘরোয়ানা । তার সাবেক দিনগুলো যেমন যক্ষের ধনের মতো মাটির নীচে পোতা। আমার মনের মধ্যে প্রথম আভাস দিয়েছিল “ক্ষুধিত পাষাণ”-এর গল্পে। a সে আজ কত শত বৎসরের কথা । নহবৎখানায় বাজছে রোশনটোর্কি দিনরাত্রে অষ্ট প্রহরের রাগিণীতে, রাস্তায় তালে তালে ঘোড়ার খুরের শব্দ উঠছে, ঘোড়সওয়ার তুর্কি ফৌজের চলছে ১ দ্রষ্টব্য রবীন্দ্র-রচনাবলী, विल খণ্ড (সুলভ দশম )