পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

O রবীন্দ্র-রচনাবলী । কুচকাওয়াজ, তাদের বর্শার ফলায় রোদ উঠছে ঝকঝকিয়ে। বাদশাহি দরবারের চার দিকে চলেছে। সর্বনেশে কানাকানি ফুসফাস। অন্দরমহলে খোলা তলোয়ার হাতে হাবসি খোজারা পাহারা দিছে। বেগমদের হামামে ছুটছে গোলাবজলের ফোয়ারা, উঠছে বাজুবন্ধ-কাকনের ঝনঝনি। আজ স্থির দাড়িয়ে শাহিবাগ, ভুলে যাওয়া গল্পের মতো ; তার চার দিকে কোথাও নেই সেই রঙ, নেই। সেই সব ধ্বনি- শুকনো দিন, রস-ফুরিয়ে-যাওয়া রাত্রি । পুরনো ইতিহাস ছিল তার হাড়গুলো বের করে ; তার মাথার খুলিটা আছে, মুকুট নেই। তার উপরে খোলস মুখোশ পরিয়ে একটা পুরোপুরি মূর্তি মনের জাদুঘরে সাজিয়ে তুলতে পেরেছি তা বললে বেশি বলা হবে । চালচিত্তির খাড়া করে একটা খসড়া মনের সামনে দাড় করিয়েছিলুম, সেটা আমার খেয়ালেরই খেলনা। কিছু মনে থাকে, অনেকখানি ভুলে যাই বলে এইরকম জোড়াতাড়া দেওয়া সহজ হয় । আশি বছর পরে এসে নিজেরই যে একখানা রূপ সামনে আজ দেখা দিয়েছে আসলের সঙ্গে তার সবটা লাইনে লাইনে মেলে না, অনেকখানি সে মনগড়া । এখানে কিছুদিন থাকার পর মেজদাদা মনে করলেন, বিদেশকে যারা দেশের রস দিতে পারে সেইরকম মেয়েদের সঙ্গে আমাকে মিলিয়ে দিতে পারলে হয়তো ঘরছাড়া মন আরাম পাবে। ইংরেজি ভাষা শেখবারও সেই হবে সহজ উপায় । তাই কিছুদিনের জন্যে বোম্বাইয়ের কোনো গৃহস্থঘরে আমি বাসা নিয়েছিলুম। সেই বাড়ির কোনো-একটি এখনকার কালের পড়াশুনোওয়ালা মেয়ে’ ঝকঝকে করে মেজে এনেছিলেন তার শিক্ষা বিলেত থেকে । আমার বিদ্যে সামান্যই, আমাকে হেলা করলে দোষ দেওয়া যেতে পারত না । তা করেন নি। পুঁথিগত বিদ্যা ফলাবার মতো পুঁজি ছিল না, তাই সুবিধে পেলেই জানিয়ে দিতুম যে কবিতা লেখবার হাত আমার আছে। আদর আদায় করবার ঐ ছিল আমার সবচেয়ে বড়ো মূলধন। র্যার কাছে নিজের এই কবিআনার জানান দিয়েছিলেম। তিনি সেটাকে মেপেজুখে নেন নি, মেনে নিয়েছিলেন। কবির কাছ থেকে একটা ডাকনাম চাইলেন, দিলেম জুগিয়ে- সেটা ভালো লাগল তার কানে। ইচ্ছে করেছিলেম সেই নামটি আমার কবিতার ছন্দে জড়িয়ে দিতে। বেঁধে দিলুম সেটাকে কাব্যের গাথুনিতে ; শুনলেন সেটা ভোরবেলাকার ভৈরবী সুরে ; বললেন, “কবি, তোমার গান শুনলে আমি বোধ হয় আমার মরণদিনের থেকেও প্ৰাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি।” এর থেকে বোঝা যাবে, মেয়েরা যাকে আদর জানাতে চায় তার কথা একটু মধু মিশিয়ে বাড়িয়েই বলে, সেটা খুশি ছড়িয়ে দেবার জন্যেই । মনে পড়ছে তার মুখেই প্ৰথম শুনেছিলুম আমার চেহারার তারিফ । সেই বাহবায় অনেক সময় গুণাপনা থাকত। যেমন, একবার আমাকে বিশেষ করে বলেছিলেন, ‘একটা কথা আমার রাখতেই হবে, তুমি কোনোদিন দাড়ি রেখো না, তোমার মুখের সীমানা যেন কিছুতেই ঢাকা না পড়ে।' উঠার এই কথা আজ পর্যন্ত রাখা হয়নি, সে কথা সকলেরই জানা আছে। আমার মুখে অবাধ্যতা প্রকাশ পাবার পূর্বেই डै।ान भूट्रा शश्लि। আমাদের ঐ বটগাছটাতে কোনো কোনো বছরে হঠাৎ বিদেশী পাখি এসে বামা বঁধে । তাদের ডানার নাচ চিনে নিতে নিতেই দেখি তারা চলে গেছে। তারা অজানা সুর নিয়ে আসে দূরের বন থেকে । তেমনি জীবনযাত্রার মাঝে মাঝে জগতের অচেনা মহল থেকে আসে আপন-মানুষের দূতী, হৃদয়ের দখলের সীমানা বড়ো করে দিয়ে যায়। না ডাকতেই আসে, শেষকালে একদিন ডেকে আর "পাওয়া যায় না। চলে যেতে যেতে বেঁচে-থাকার চাদরটার উপরে ফুলকটা কাজের পাড় বসিয়ে দেয়, বরাবরের মতো দিনরাত্রির দাম দিয়ে যায় বাড়িয়ে । ১ অন্নপূর্ণ তরখড় বা আনা তরখড়, ডাক্তার আত্মারাম পাণ্ডুরঙ এর কন্যা