পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

stebig RSD 2 থাকিতেন ; যখন যেটা ইচ্ছা হইত। পাঠ করিতেন, এই তো ছিল তার কাজ, বিষয় কী করিয়া রক্ষা হইত তাহা বিষয়ই জানে । এবং পূর্বেই আভাসে বলা গিয়াছে, মানুষের মধ্যে তাহার সম্পর্ক ছিল কেবল গিরিবালার সহিত । গিরিবালার ভাইরা ইস্কুলে যাইত এবং ফিরিয়া আসিয়া মূঢ় ভগ্নীটিকে কোনোদিন জিজ্ঞাসা করিত, পৃথিবীর আকার কিরূপ ; কোনোদিন বা প্রশ্ন করিত, সূৰ্য বড়ো না পৃথিবী বড়ো— সে যখন ভুল বলিত তখন তাহার প্রতি বিপুল অবজ্ঞা দেখাইয়া ভ্ৰম সংশোধন করিত । সূৰ্য পৃথিবী অপেক্ষা বৃহৎ, এ মতটা যদি গিরিবালার নিকট প্রমাণাভাবে অসিদ্ধ বলিয়া বোধ হইত এবং সেই সন্দেহ যদি সে সাহস করিয়া প্ৰকাশ করিত, তবে তাহার ভাইরা তাহাকে দ্বিগুণ উপেক্ষাভরে কহিত, “ইস ! আমাদের বইয়ে লেখা আছে আর তুই-” r ছাপার বইয়ে এমন কথা লেখা আছে শুনিয়া গিরিবালা সম্পূর্ণ নিরুত্তর হইয়া যাইত, দ্বিতীয় আৱ-কোনো প্ৰমাণ তাহার নিকট আবশ্যক বোধ হইত না । কিন্তু তাহার মনে মনে বড়ো ইচ্ছা করিত, সেও দাদাদের মতো বই লইয়া পড়ে । কোনো-কোনোদিন সে আপন ঘরে বসিয়া কোনো-একটা বই খুলিয়া বিড় বিড় করিয়া পড়ার ভান করিত এবং অনর্গল পাতা উলটাইয়া যাইত । ছাপার কালো কালো ছোটো ছোটো অপরিচিত অক্ষরগুলি কী যেন এক মহারহস্যশালার সিংহদ্বারে দলে দলে সার বাধিয়া স্কন্ধের উপরে ইকার ঐকার রেফ উচাইয়া পাহারা দিত, গিরিবালার কোনো প্রশ্নের কোনোই উত্তর করিত না । কথামালা তাহার ব্যাঘ্ৰ শৃগাল অশ্ব গদ্যভের একটি কথাও কৌতুহলকাতর বালিকার নিকট ফাস করিত না এবং আখ্যানমঞ্জরী তাহার সমস্ত আখ্যানগুলি লইয়া মৌনব্রতের মতো নীরবে চাহিয়া থাকিত । গিরিবালা তাহার ভাইদের নিকট পড়া শিখিবার প্রস্তাব করিয়াছিল। কিন্তু তাহার ভাইরা সে কথায় কৰ্ণপাতমাত্র করে নাই । একমাত্র শশিভূষণ তাহার সহায় ছিল । গিরিবালার নিকট কথামালা এবং আখ্যানমঞ্জরী যেমন দুর্ভেদ্য রহস্যপূর্ণ ছিল শশিভূষণও প্রথম প্রথম অনেকটা সেইরূপ ছিল । লোহার গরাদে দেওয়া রাস্তার ধারের ছোটাে বসিবার ঘরটিতে যুবক একাকী তক্তপোশের উপর পুস্তকে পরিবৃত হইয়া বসিয়া থাকিত । গিরিবালা গরাদে ধরিয়া বাহিরে দাড়াইয়া অবাক হইয়া এই নতপূষ্ঠ পাঠনিবিষ্ট অদ্ভুত লোকটিকে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিত, পুস্তকের সংখ্যা তুলনা করিয়া মনে মনে স্থির করিত, শশিভূষণ তাহার ভাইদের অপেক্ষা অনেক বেশি বিদ্বান । তদপেক্ষা বিস্ময়জনক ব্যাপার তাহার নিকট আর কিছুই ছিল না । কথামােলা প্রভৃতি পৃথিবীর প্রধান প্রধান পাঠ্যপুস্তকগুলি শশিভূষণ যে নিঃশেষপূর্বক পাঠ করিয়া ফেলিয়াছে, এ বিষয়ে তাহার সন্দেহমাত্র ছিল না | এইজন্য, শশিভূষণ যখন পুস্তকের পাত উলটাইত সে স্থিরভাবে দাড়াইয়া তাহার জ্ঞানের অবধি নির্ণয় করিতে পারিত না । অবশেষে এই বিস্ময়মগ্ন বালিকাটি ক্ষীণদৃষ্টি শশিভূষণেরও মনোযোগ আকর্ষণ করিল। শশিভূষণ একদিন একটা ঝকঝকে বাধানো বই খুলিয়া বলিল, “গিরিবালা, ছবি দেখবি আয় ।” গিরিবালা তৎক্ষণাৎ দৌডিয়া পালাইয়া গেল । কিন্তু পরদিন সে পুনর্বার ডুরে কাপড় পরিয়া সেই গরাদের বাহিরে দাড়াইয়া সেইরূপ গভীর মৌন শনোযোগের সহিত শশিভূষণের অধ্যয়নকার্য নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিল । শশিভূষণ সেদিনও উকিল এবং সেদিনও সে বেণী দুলাইয়া উর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া পলাইল । এইরূপে তাঁহাদের পরিচয়ের সূত্রপাত হইয়া ক্ৰমে কখন ঘনিষ্ঠতর হইয়া উঠিল এবং কখন যে "লক গরীদের বাহির হইতে শশিভূষণের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল, তাহার তক্তপােশের উপর সােল গুস্তকস্তুপের মধ্যে স্থান পাইল ঠিক সে তারিখটা নির্ণয় কবিয়া দিতে ঐতিহাসিক গবেষণার {্যক । "ত্ষণের নিকট গিরিবালার লেখাপড়ার চর্চা আরম্ভ হইল। শুনিয়া সকলে হাসিবেন, এই "বিটি তাহার ক্ষুদ্র ছাত্রীকে কেবল যে অক্ষর, বানান এবং ব্যাকরণ শিখাইত তাহা নহে— অনেক