পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\○○の রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রার্থনা করিয়াছিল তাহা দেবতারা শুনেন নাই এবং পাঠকদিগকেও শুনাইবার কোনো আবশ্যক দেখি ୩ | তখন ব্যথিতহাদয় বালিকা দুই-একদিন চারুপাঠ হস্তে গুরুগৃহে গমন বন্ধ করিল। এবং সেই দুই-একদিন পরে এই বিচ্ছেদের ফল পরীক্ষা করিয়া দেখিবার জন্য সে অন্য ছলে শশিভূষণের গৃহসম্মুখবর্তী পথে আসিয়া কটাক্ষপাত করিয়া দেখিল, শশিভূষণ সেই কালো বইখানা ফেলিয়া একাকী দাড়াইয়া হাত নাড়িয়া লোহার গরাব্দেগুলার প্রতি বিজাতীয় ভাষায় বক্তৃতা প্রয়োগ করিতেছেন । বোধ । করি, বিচারকের মন কেমন করিয়া গলাইবেন এই লোহাগুলার উপর তাহার পরীক্ষা হইতেছে । সংসারে অনভিজ্ঞ গ্রন্থবিহারী শশিভূষণের ধারণা ছিল যে, পুরাকালে ডিমস্থিানীস, সিসিরো, বার্ক, শেরিডন প্ৰভৃতি বাগীগণ বাক্যবলে যে-সকল অসামান্য কার্য করিয়া গিয়াছেন— যেরূপ শব্দভেদী শর বর্ষণে অন্যায়কে ছিন্নভিন্ন, অত্যাচারকে লাঞ্ছিত এবং অহংকারকে ধূলিশায়ী করিয়া দিয়াছেন, আজিকার দোকানদারির দিনেও তাহা অসম্ভব নহে। প্ৰভুত্বমদগর্বিত উদ্ধত ইংরাজকে কেমন করিয়া তিনি জগৎসমক্ষে লজ্জিত ও অনুতপ্ত করিবেন, তিলকুচি গ্রামের জীৰ্ণ ক্ষুদ্র গৃহে দাড়াইয়া শশিভূষণ তাহারই চর্চা করিতেছিলেন । আকাশের দেবতারা শুনিয়া হাসিয়াছিলেন কি তাহাদের দেবচক্ষু অশ্রুসিক্ত হইতেছিল, তাহা কেহ বলিতে পারে না । সুতরাং সেদিন গিরিবালা তাহার দৃষ্টিপথে পড়িল না ; সেদিন বালিকার অঞ্চলে জাম ছিল না ; পূর্বে একবার জামের আঁটি ধরা পডিয়া অবধি ঐ ফল সম্বন্ধে সে অত্যন্ত সংকুচিত ছিল । এমন-কি, শশিভূষণ যদি কোনােদিন নিরীহ ভাবে জিজ্ঞাসা করিত ‘গিরি, আজ জাম নেই ? সে সেটাকে গৃঢ় উপহাস জ্ঞান করিয়া সক্ষোভে “যাঃও’ বলিয়া তর্জন করিয়া পলায়নের উপক্রম করিত । জামের আঁটির অভাবে আজ তাহাকে একটা কৌশল অবলম্বন করিতে হইল। সহসা দূরের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া বালিকা উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, “স্বর্ণ ভাই, তুই যাস নে, আমি এখনি যাচ্ছি।” পুরুষ পাঠক মনে করিতে পারেন যে, কথাটা স্বৰ্ণলতা নামক কোনো দূরবর্তিনী সঙ্গিনীকে লক্ষ্য করিয়া উচ্চারিত, কিন্তু পাঠিকারা সহজেই বুঝিতে পরিবেন দূরে কেহই ছিল না, লক্ষ্য অত্যন্ত নিকট । কিন্তু হায়, অন্ধ পুরুষের প্রতি সে লক্ষ ভ্ৰষ্ট হইয়া গেল । শশিভূষণ যে শুনিতে পান নাই তাঁহা নহে, তিনি তাহার মর্ম গ্ৰহণ করিতে পারিলেন না । তিনি মনে করিলেন, বালিকা সত্যই ক্ৰীড়ার জন্য উৎসুকী— এবং সেদিন তাহাকে খেলা হইতে অধ্যয়নে আকর্ষণ করিয়া আনিতে তাহার অধ্যবসায় ছিল না, কারণ তিনিও সেদিন কোনো কোনাে হৃদয়ের দিকে লক্ষ করিয়া তীক্ষ শর সন্ধান করিতেছিলেন । বালিকার ক্ষুদ্র হস্তের সামান্য লক্ষ্য যেমন ব্যর্থ হইয়াছিল তাহার শিক্ষিত হস্তের মহৎ লক্ষ্যও সেইরূপ ব্যর্থ হইয়াছিল, পাঠকেরা সে সংবাদ পূর্বেই অবগত হইয়াছেন । জামের আঁটির একটা গুণ এই যে, একে একে অনেকগুলি নিক্ষেপ করা যায়, চারিটি নিম্ফল হইলে অন্তত পঞ্চমটি ঠিক স্থানে গিয়া লাগিতে পারে । কিন্তু স্বর্ণ হাজার কাল্পনিক হউক, তাহাকে “এখনি যাচ্ছি। আশা দিয়া অধিকক্ষণ দাড়াইয়া থাকা যায় না । থাকিলে স্বর্ণের অস্তিত্ব সম্বন্ধে লোকের স্বভাবতই সন্দেহ জন্মিতে পারে । সুতরাং সে উপায়টি যখন নিম্বফল হইল। তখন গিরিবালাকে অবিলম্বে চলিয়া যাইতে হইল। তথাপি, স্বর্ণনামী কোনাে দূরস্থিত সহচরীর সঙ্গ লাভ করিবার অভিলাষ আন্তরিক