পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ NR O রবীন্দ্র-রচনাবলী কখন একদিন অকস্মাৎ সেই ঘূর্ণ্যমান সংসারচক্র হইতে বেগে বিচ্ছিন্ন হইয়া রমণী অতি দূরে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িল, সে-সকল বিবরণ বিস্তারিত করিয়া বলিবার আবশ্যক দেখি না । একদিন গভীর রাত্রে পিতা মাতা ভ্ৰাতা এবং গৃহ ছাড়িয়া হেমশশী বিনোদচন্দ্ৰ-ছদ্মনামধারী মোহিতের সহিত এক গাড়িতে উঠিয়া বসিল । দেবপ্রতিমা যখন তাহার সমস্ত মাটি এবং খড় এবং রাংতার গহনা লইয়া তাহার পার্শ্বে আসিয়া সংলগ্ন হইল। তখন সে লজ্জায় ধিককারে মাটিতে মিশিয়া গেল । অবশেষে গাডি যখন ছাডিয়া দিল তখন সে কাদিয়া মোহিতের পায়ে ধরিল, বলিল, “ওগো, পায়ে পড়ি আমাকে আমার বাডি রেখে এসো ।” মোহিত শশব্যস্ত হইয়া তাহার মুখ চাপিয়া ধরিল ; গাড়ি দ্রুতবেগে চলিতে লাগিল । জলনিমগ্ন মরণাপন্ন ব্যক্তির যেমন মুহুর্তের মধ্যে জীবনের সমস্ত ঘটনাবলী স্পষ্ট মনে পড়ে, তেমনি সেই দ্বারারুদ্ধ গাড়ির গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে হেমশশীর মনে পড়িতে লাগিল, প্ৰতিদিন আহারের সময় তাহার বাপ তাহাকে সম্মুখে না লইয়া খাইতে বসিতেন না ; মনে পড়িল, তাহার সর্বকনিষ্ঠ ভাইটি ইস্কুল হইতে আসিয়া তাহার দিদির হাতে খাইতে ভালোবাসে ; মনে পড়িল, সকালে সে তাহার মায়ের সহিত পান সাজিতে বসিত এবং বিকালে মা তাহার চুল বাধিয়া দিতেন । ঘরের প্রত্যেক ক্ষুদ্র কোণ এবং দিনের প্রত্যেক ক্ষুদ্র কাজটি তাহার মনের সম্মুখে জাজ্বল্যমান হইয়া উঠিতে লাগিল । তখন তাহার নিভূত জীবন এবং ক্ষুদ্র সংসারটিকেই স্বৰ্গ বলিয়া মনে হইল । সেই পানিসাজা, চুলবাধা, পিতার আহারস্থলে পাখা-করা ছুটির দিনে মধ্যাহ্ননিদ্রার সময় তাহার। পাকাচুল তুলিয়া দেওয়া, ভাইদের দৌরাত্মা সহ্য করা— এ সমস্তই তাহার কাছে পরম শান্তিপূর্ণ দুর্লভ সুখের মতো বোধ হইতে লাগিল ; বুঝিতে পারিল না, এ-সব থাকিতে সংসারে আর কোন সুখের আবশ্যক আছে । মনে হইতে লাগিল, পৃথিবীতে ঘরে ঘরে সমস্ত কুলকনারা এখন গভীর সুষপ্তিতে নিমগ্ন ; সেই আপনার ঘরে আপনার শাখাটির মধ্যে নিস্তব্ধ রাত্ৰেক নিশ্চিন্ত নিদ্রা যে কত সুখের, তাহা ইতিপূর্বে কেন সে বুঝিতে পারে নাই । ঘরের মেয়েরা কাল সকালবেলায় ঘরের মধ্যে জাগিয়া উঠিবে, নিঃসংকোচ - নিত্যকমের মধ্যে প্ৰবৃত্ত হইবে, আর গৃহচ্যুতা হেমশশীর এই নিদ্রাহীন রাত্রি কোনখানে গিয়া প্ৰভাত হইবে এবং সেই নিরানন্দ প্ৰভাতে তাহদের সেই গলির ধারের ছোটোখাটো ঘরকন্নাটির উপর যখন সকালবেলাকার চিরপরিচিত শান্তিময় হাস্যপূৰ্ণ রৌদ্রটি আসিয়া পতিত হইবে তখন সেখানে সহসা কী লজ্জা প্ৰকাশিত হইয়া পড়িবে— কী লাঞ্ছনা, কী হাহাকার জাগ্রত হইয়া উঠিবে ! হেম হৃদয় বিদীর্ণ করিয়া কাদিয়া মরিতে লাগিল ; সকরুণ অনুনয় সহকারে বলিতে লাগিল, “এখনো রাত আছে । আমার মা, আমার দুটি ভাই, এখনো জাগে নাই ; এখনো আমাকে ফিরাইয়া রাখিয়া আইস ।” কিন্তু, তাহার দেবতা কর্ণপাত করিল না ; এক দ্বিতীয় শ্রেণীর চক্ৰশব্দমুখরিত রথে চড়াইয়া তাহাকে তাহার বহুদিনের আকাঙিক্ষত স্বৰ্গলোকাভিমুখে লইয়া চলিল । ইহার অনতিকাল পরেই দেবতা এবং স্বৰ্গ পুনশ্চ আর-একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর জীৰ্ণরথে চড়িয়া আর-এক পথে প্ৰস্থান করিলেন- রমণী আকণ্ঠ পঙ্কের মধ্যে নিমজিত হইয়া রহিল । মোহিতমোহনের পূর্ব ইতিহাস হইতে এই একটিমাত্র ঘটনা উল্লেখ করিলাম । রচনা পাছে ‘একঘেয়ে’ হইয়া উঠে এইজন্য অন্যগুলি বলিলাম না । এখন সে-সকল পুরাতন কথা উত্থাপন করিবার আবশ্যক ও নাই । এখন সেই বিনোদচন্দ্ৰ নাম স্মরণ করিয়া রাখে, এমন কোনো লোক জগতে আছে কিনা সন্দেহ । এখন মোহিত শুদ্ধাচারী হইয়াছেন, তিনি আহিব্রুকতপণ করেন এবং সর্বদাই শাস্ত্রালোচনা করিয়া থাকেন । নিজের ছোটাে ছোটাে ছেলেদিগকেও