পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SE SS রবীন্দ্র-রচনাবলী । তখন একদিন আমার স্ত্রী আমাকে বলিলেন, “যখন ব্যামোও সারিবে না এবং শীঘ্ৰ আমার মরিবার আশাও নাই তখন আর-কতদিন এই জীবনমৃতকে লইয়া কাটাইবে । তুমি আর-একটা বিবাহ করো ।” এটা যেন কেবল একটা সুযুক্তি এবং সাদবিবেচনার কথা— ইহার মধ্যে যে, ভারি একটা মহত্ত্ব বীরত্ব বা অসামান্য কিছু আছে, এমন ভাব তাহার লেশমাত্র ছিল না । । এইবার আমার হাসিবার পালা ছিল । কিন্তু, আমার কি তেমন করিয়া হাসিবার ক্ষমতা আছে । আমি উপন্যাসের প্রধান নায়কের ন্যায় গভীর সমুচ্চভাবে বলিতে লাগিলাম, “যতদিন এই দেহে জীবন আছে--” s তিনি বাধা দিয়া কহিলেন, “নাও নাও !! আর বলিতে হইবে না । তোমার কথা শুনিয়া আমি আর বাচি না ।” আমি পরাজয় স্বীকার না করিয়া বলিলাম, “এ জীবনে আর-কাহাকেও ভালোবাসিতে পারিব না ।” শুনিয়া আমার স্ত্রী ভারি হাসিয়া উঠিলেন । তখন আমাকে ক্ষান্ত হইতে হইল । জানি না, তখন নিজের কাছেও কখনো স্পষ্ট স্বীকার করিয়াছি কি না। কিন্তু এখন বুঝিতে পারিতেছি, এই আরোগ্য-আশাহীন সেবাকার্যে আমি মনে মনে পরিশ্রান্ত হইয়া গিয়াছিলাম । এ কার্যে যে ভঙ্গ দিব, এমন কল্পনাও আমার মনে ছিল না ; অথচ, চিরজীবন এই চির রুগণকে লইয়া যাপন করিতে হইবে, এ কল্পনাও আমার নিকট পীড়াজনক হইয়াছিল । হায়, প্রথম যৌবনকালে যখন সম্মুখে তাকাইয়াছিলাম তখন প্রেমের কুহিকে, সুখের আশ্বাসে, সৌন্দর্যের মরীচিকায় সমস্ত ভবিষ্যৎ জীবন প্ৰফুল্ল দেখাইতেছিল । আজ হইতে শেষ পর্যন্ত কেবলই আশাহীন সুদীর্ঘ সাতৃষ্ণ মরুভূমি । আমার সেবার মধ্যে সেই আস্তরিক শ্রান্তি নিশ্চয় তিনি দেখিতে পাইয়াছিলেন । তখন জানিতাম না। কিন্তু এখন সন্দেহমাত্ৰ নাই যে, তিনি আমাকে যুক্তাক্ষরহীন প্ৰথমভাগ শিশুশিক্ষার মতো অতি সহজে বুঝিতেন । সেইজন্য যখন উপন্যাসের নায়ক সাজিয়া গম্ভীরভাবে তাহার নিকট কবিত্ব ফলাইতে যাইতাম তিনি এমন সুগভীর স্নেহ। অথচ অনিবার্য কৌতুকের সহিত হাসিয়া উঠিতেন । আমার নিজের অগোচর অস্তরের কথাও অন্তর্যামীর ন্যায় তিনি সমস্তই জানিতেন, এ কথা মনে করিলে আজও লজায় মরিয়া যাইতে ইচ্ছা করে । হারান ডাক্তার আমাদের স্বজাতীয় । তাহার বাড়িতে আমার প্রায়ই নিমন্ত্রণ থাকিত । কিছুদিন তাহার বয়স পনেরো হইবে । ডাক্তার বলেন, তিনি মনের মতো পাত্ৰ পান নাই বলিয়া বিবাহ দেন নাই । কিন্তু বাহিরের লোকের কাছে গুজব শুনিতাম— মেয়েটির কুলের দোষ ছিল । কিন্তু, আর কোনো দোষ ছিল না । যেমন সুরূপ তেমনি সুশিক্ষা । সেইজন্য মাঝে মাঝে এক-একদিন তাহার সহিত নানা কথার আলোচনা করিতে করিতে আমার বাডি ফিরিতে রাত হইত, আমার স্ত্রীকে ঔষধ খাওয়াইবার সময় উত্তীর্ণ হইয়া যাইত । তিনি জানিতেন, আমি হারান ডাক্তারের বাড়ি গিয়াছি কিন্তু বিলম্বের কারণ একদিনও আমাকে জিজ্ঞাসাও করেন নাই । মরুভূমির মধ্যে আর-একবার মরীচিকা দেখিতে লাগিলাম । তৃষ্ণা যখন বুক পর্যন্ত তখন চোখের সামনে কুলপরিপূর্ণ স্বচ্ছ জল ছলছল ঢলঢল করিতে লাগিল । তখন মনকে প্ৰাণপণে টানিয়া আর ফিরাইতে পারিলাম না । রোগীর ঘর আমার কাছে দ্বিগুণ নিরানন্দ হইয়া উঠিল । তখন প্রায়ই শুশ্রুষা করিবার এবং ঔষধ খাওয়াইবার নিয়ম ভঙ্গ হইতে লাগিল । হারান ডাক্তার আমাকে প্ৰায় মাঝে মাঝে বলিতেন, যাহাদের রোগ আরোগ্য হইবার কোনো সম্ভাবনা নাই, তাহাদের পক্ষে মৃত্যুই ভালো ; কারণ, বাচিয়া তাহাদের নিজেরও সুখ নাই, অন্যেরও অসুখ । কথাটা সাধারণভাবে বলিতে দোষ নাই, তথাপি আমার স্ত্রীকে লক্ষ্য করিয়া এমন প্ৰসঙ্গ উত্থাপন করা তাহার উচিত হয় নাই । কিন্তু, মানুষের জীবনমৃত্যু সম্বন্ধে ডাক্তারদের মন এমন অসাড় যে, তাহারা ঠিক আমাদের মনের অবস্থা বুঝিতে পারে না ।