পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ S. G. হঠাৎ একদিন পাশের ঘর হইতে শুনিতে পাইলাম, আমার স্ত্রী হারানবাবুকে বলিতেছেন, “ডাক্তার, কতকগুলা মিথ্যা ঔষধ গিলাইয়া ডাক্তারখানার দেনা বাড়াইতেছ। কেন । আমার প্রাণটাই যখন একটা ব্যামো, তখন এমন একটা ওষুধ দাও যাহাতে শীঘ্র এই প্ৰাণটা যায় ।” ডাক্তার বলিলেন, “ছি, এমন কথা বলিবেন না ।” কথাটা শুনিয়া হঠাৎ আমার বক্ষে বড়ো আঘাত লাগিল। ডাক্তার চলিয়া গেলে আমার স্ত্রীর ঘরে গিয়া তাহার শয্যাপ্রাস্তে বসিলাম, তাহার কপালে ধীরে ধীরে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলাম । তিনি কহিলেন, “এ ঘর বড়ো গরম, তুমি বাহিরে যাও । তোমার বেড়াইতে যাইবার সময় হইয়াছে । খানিকটা না বেড়াইয়া আসিলে আবার রাত্রে তোমার ক্ষুধা হইবে না ।” বেড়াইতে যাওয়ার অর্থ ডাক্তারের বাড়ি যাওয়া । আমিই তাহাকে বুঝাইয়াছিলাম, ক্ষুধাসঞ্চারের, পক্ষে খানিকটা বেড়াইয়া আসা বিশেষ আবশ্যক । এখন নিশ্চয় বলিতে পারি, তিনি প্রতিদিনই আমার এই ছলনাটুকু বুঝিতেন । আমি নির্বোধ, মনে করিতাম। তিনি নির্বোধি । এই বলিয়া দক্ষিণাচরণবাবু অনেকক্ষণ করতলে মাথা রাখিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন । অবশেষে কহিলেন, “আমাকে একগ্লাস জল আনিয়া দাও ।” জল খাইয়া বলিতে লাগিলেন একদিন ডাক্তারবাবুর কন্যা মনোরমা। আমার স্ত্রীকে দেখিতে আসিবার ইচ্ছা প্ৰকাশ করিলেন । জানি না, কী কারণে তাহার সে প্রস্তাব আমার ভালো লাগিল না। কিন্তু, প্রতিবাদ করিবার কোনাে হেতু ছিল না । তিনি একদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাদের বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন । সেদিন আমার স্ত্রীর বেদনা অন্য দিনের অপেক্ষা কিছু বাড়িয়া উঠিয়াছিল । যেদিন তাহার ব্যথা বাড়ে সেদিন তিনি অত্যন্ত স্থির নিস্তব্ধ হইয়া থাকেন : কেবল মাঝে মাঝে মুষ্টি বদ্ধ হইতে থাকে এবং মুখ নীল হইয়া আসে, তাহাতেই তাহার যন্ত্রণা বুঝা যায়। ঘরে কোনো সাড়া ছিল না, আমি শয্যাপ্ৰান্তে চুপ করিয়া বসিয়া ছিলাম ; সেদিন আমাকে বেড়াইতে যাইতে অনুরোধ করেন এমন সামর্থ্য তাহার ছিল না কিংবা হয়তো বড়ো কষ্টের সময় আমি কাছে থাকি, এমন ইচ্ছা তাহার মনে মনে ছিল । চোখে লাগিবে বলিয়া কেরোসিনের আলোটা দ্বারের পাৰ্থে ছিল । ঘর অন্ধকার এবং নিস্তব্ধ । কেবল এক—একবার যন্ত্রণার কিঞ্চিৎ উপশমে আমার স্ত্রীর গভীর দীর্ঘনিশ্বাস শুনা যাইতেছিল । এমন সময়ে মনোরম ঘরের প্রবেশদ্বারে দাড়াইলেন । বিপরীত দিক হইতে কেরোসিনের আলো আসিয়া তাহার মুখের উপর পড়িল । আলো-আঁধারে লাগিয়া তিনি কিছুক্ষণ ঘরের কিছুই দেখিতে না । পাইয়া দ্বারের নিকট দাড়াইয়া ইতস্তত করিতে লাগিলেন । আমার স্ত্রী চমকিয়া আমার হাত ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও কে !”- তাহার সেই দুর্বল অবস্থায় হঠাৎ অচেনা লোক দেখিয়া ভয় পাইয়া আমাকে দুই-তিনবার অস্ফুটস্বরে প্রশ্ন করিলেন, “ও কে ! ও কে গো !” আমার কেমন দুবুদ্ধি হইল আমি প্রথমেই বলিয়া ফেলিলাম, “আমি চিনি না।” বলিবামাত্রই কে যেন আমাকে কশাঘাত করিল। পরের মুহুর্তেই বলিলাম, “ওঃ, আমাদের ডাক্তারবাবুর কন্যা !" স্ত্রী একবার আমার মুখের দিকে চাহিলেন ; আমি তাহার মুখের দিকে চাহিতে পারিলাম না । পরীক্ষণেই তিনি ক্ষীণস্বরে অভ্যাগতকে বলিলেন, “আপনি আসুন ।” আমাকে বলিলেন, “আলােটা "ן זa)& মনোরম ঘরে আসিয়া বসিলেন । তাহার সহিত রোগিণীর অল্পস্বল্প আলাপ চলিতে লাগিল । এমন সময় ডাক্তারবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন । তিনি তাহার ডাক্তারখানা হইতে দুই শিশি ওষুধ সঙ্গে আনিয়াছিলেন । সেই দুটি শিশি বাহির করিয়া আমার স্ত্রীকে বলিলেন, “এই নীল শিশিটা মালিশ করিবার, আর এইটি খাইবার। দেখিবেন, দুইটাতে মিলাইবেন না, এ ওষুধটা ভারি বিষ ।”