পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V) SVe রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আমাকেও একবার সতর্ক করিয়া দিয়া ঔষধ দুটি শয্যাপার্শ্ববতী টেবিলে রাখিয়া দিলেন । বিদায় লাইবার সময় ডাক্তার তাহার কন্যাকে ডাকিলেন । মনোরমা কহিলেন, “বাবা, আমি থাকি-না কেন । সঙ্গে স্ত্রীলোক কেহ নাই, ইহাকে সেবা করিবে: কে ?” আমার স্ত্রী ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন ; বলিলেন, “না, না, আপনি কষ্ট করিবেন না । পুরানো ঝি আছে, সে আমাকে "মায়ের মতো যত্ব করে ।” ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, “উনি মা-লক্ষ্মী, চিরকাল পরের সেবা করিয়া আসিয়াছেন, অন্যের সেবা সহিতে পারেন না ।” কন্যাকে লইয়া ডাক্তার গমনের উদযোগ করিতেছেন এমন সময় আমার স্ত্রী বলিলেন, “ডাক্তারবাবু, ইনি এই বদ্ধঘরে অনেকক্ষণ বসিয়া আছেন, ইহাকে একবার বাহিরে বেড়াইয়া লইয়া আসিতে পারেন ?” ডাক্তারবাবু আমাকে কহিলেন, “আসুন-না , আপনাকে নদীর ধার হইয়া একবার বেড়াইয়া আনি ৷” আমি ঈষৎ আপত্তি দেখাইয়া অনতিবিলম্বে সম্মত হইলাম। ডাক্তারবাবু যাইবার সময় দুই শিশি ঔষধ সম্বন্ধে আবার স্ত্রীকে সতর্ক করিয়া দিলেন । সেদিন ডাক্তারের বাড়িতেই আহার করিলাম। ফিরিয়া আসিতে রাত হইল। আসিয়া দেখি আমার স্ত্রী ছটফট করিতেছেন । অনুতাপে বিদ্ধ হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার কি ব্যথা বাডিয়াছে।” তিনি উত্তর করিতে পারিলেন না, নীরবে আমার মুখের দিকে চাহিলেন । তখন তাহার কণ্ঠরোধ হইয়াছে । আমি তৎক্ষণাৎ সেই রাত্রেই ডাক্তারকে ডাকাইয়া আনিলাম । ডাক্তার প্রথমটা আসিয়া অনেকক্ষণ কিছুই বুঝিতে পারিলেন না । অৱশেষে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সেই ব্যথাটা কি বাডিয়া উঠিয়াছে । ঔদ্ধধটা একবার মালিশ করিলে হয় না ?” বলিয়া শিশিট টেবিল হইতে লইয়া দেখিলেন, সেটা খালি । আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি ভুল করিয়া এই ওষুধটা খাইয়াছেন ?” আমার স্ত্রী ঘাড় নাডিয়া নীরবে জানাইলেন, “ইহা ।” ডাক্তার তৎক্ষণাৎ গাড়ি করিয়া তাহার বাড়ি হইতে পাম্প আনিতে ছুটলেন । আমি অর্ধমূছিতের ন্যায় আমার স্ত্রীর বিছানার উপর গিয়া পড়িলাম । তখন, মাতা তাহার পীড়িত শিশুকে যেমন করিয়া সাস্তুনা করে তেমনি করিয়া তিনি আমার মাথা র্তাহার বক্ষের কাছে টানিয়া লইয়া দুই হস্তের স্পর্শে আমাকে তাহার মনের কথা বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন । কেবল তাহার সেই করুণ সম্পর্শের দ্বারাই আমাকে বারংবার করিয়া বলিতে লাগিলেন, “শোক করিয়ো না, ভালেই হইয়াছে, তুমি সুখী হইবে, এবং সেই মনে করিয়া আমি সুখে মরিলাম।” ডাক্তার যখন ফিরিলেন, তখন জীবনের সঙ্গে সঙ্গে আমার স্ত্রীর সকল যন্ত্রণার অবসান হইয়াছে। দক্ষিণাচরণ আর-একবার জল খাইয়া বলিলেন, “উঃ, বড়ো গরম ” বলিয়া দ্রুত বাহির হইয়া বারকয়েক বারান্দায় পায়চারি করিয়া আসিয়া বসিলেন । বেশ বোঝা গেল, তিনি বলিতে চাহেন না কিন্তু আমি যেন জাদু করিয়া তাহার নিকট হইতে কথা কড়িয়া লইতেছি । আবার আরম্ভ করিলেন মনোরমাকে বিবাহ করিয়া দেশে ফিরিলাম । মনোরমা তাহার পিতার সম্মতিক্রমে আমাকে বিবাহ করিল ; কিন্তু আমি যখন তাহাকে আদরের কথা বলিতাম, প্ৰেমালাপ করিয়া তাহার হৃদয় অধিকার করিবার চেষ্টা করিতাম, সে হাসিত না, গভীর হইয়া থাকিত । তাহার মনের কোথায় কোনখানে কী খটকা লাগিয়া গিয়াছিল, আমি কেমন করিয়া বুঝিব ?