পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

set. \bՀԳ এইসময় আমার মদ খাইবার নেশা অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিল । একদিন প্ৰথম শরতের সন্ধ্যায় মনোরমাকে লইয়া আমাদের বরানগরের বাগানে বেড়াইতেছি । ছমছমে অন্ধকার হইয়া আসিয়াছে। পাখিদের বাসায় ডানা ঝাড়িবার শব্দটুকুও নাই। কেবল বেড়াইবার পথের দুইধারে ঘনছায়াবৃত ঝাউগাছ বাতাসে সশব্দে কঁাপিতেছিল। শ্রান্তি বোধ করিতেই মনোরম সেই বকুলতার শুভ্ৰ পাথরের বেদীর উপর আসিয়া নিজের দুই বাহুর উপর মাথা রাখিয়া শয়ন করিল । আমিও কাছে আসিয়া বসিলাম । সেখানে অন্ধকার আরো ঘনীভূত; যতটুকু আকাশ দেখা যাইতেছে একেবারে তারায় আচ্ছন্ন ; তরুতলের ঝিল্লিধ্বনি যেন অনন্তগগনবক্ষচু্যত নিঃশব্দতার নিম্নপ্রান্তে একটি শব্দের সরু পাড় বুনিয়া দিতেছে । সেদিনও বৈকালে আমি কিছু মদ খাইয়াছিলাম, মনটা বেশ একটু তরল্যাবস্থায় ছিল । অন্ধকার যখন চোখে সহিয়া আসিল তখন বনচ্ছায়াতলে পাণ্ডুর বর্ণে অঙ্কিত সেই শিথিল-অঞ্চল শ্ৰান্তকায় রমণীর আবছায়া মূর্তিটি আমার মনে এক অনিবাৰ্য আবেগের সঞ্চার করিল। মনে হইল, ও যেন একটি ছায়া, ওকে যেন কিছুতেই দুই বাহু দিয়া ধরিতে পারিব না। এমন সময় অন্ধকার ঝাউগাছের শিখরদেশে যেন আগুন ধরিয়া উঠিল ; তাহার পরে কৃষ্ণপক্ষের জীর্ণপ্ৰান্ত হলুদবৰ্ণ চাদ ধীরে ধীরে গাছের মাথার উপরকার আকাশে আরোহণ করিল ; সাদা পাথরের উপর সাদা শাড়িপরা সেই শ্ৰান্তশয়ান রমণীর মুখের উপর জ্যোৎস্না আসিয়া পড়িল । আমি আর থাকিতে পারিলাম না। কাছে আসিয়া দুই হাতে তাহার হাতটি তুলিয়া ধরিয়া কহিলাম, “মনোরমা, তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না, কিন্তু তোমাকে আমি ভালোবাসি । তোমাকে আমি কোনোকালে ভুলিতে পারিব না ।” কথাটা বলিবামাত্র চমকিয়া উঠিলাম ; মনে পড়িল, ঠিক এই কথাটা আর একদিন আর কাহাকেও বলিয়াছি ! এবং সেই মুহুর্তেই বকুলগাছের শাখার উপর দিয়া ঝাউগাছের মাথার উপর দিয়া, কৃষ্ণপক্ষের পীতবর্ণ ভাঙা চাঁদের নীচে দিয়া গঙ্গার পূর্বপার হইতে গঙ্গার সুদূর পশ্চিম পার পর্যন্ত হাহা— হাহা— হাহা করিয়া অতি দ্রুতবেগে একটা হাসি বহিয়া গেল । সেটা মৰ্মভেদী হাসি কি অভ্ৰভেদী হাহাকার, বলিতে পারি না । আমি তদণ্ডেই পাথরের বেদীর উপর হইতে মুছিত হইয়া নীচে পড়িয়া গেলাম । মূৰ্ছাভঙ্গে দেখিলাম, আমার ঘরে বিছানায় শুইয়া আছি। স্ত্রী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার হঠাৎ এমন হইল কেন ?” আমি কঁপিয়া উঠিয়া বলিলাম, “শুনিতে পাও নাই, সমস্ত আকাশ ভরিয়া হাহা করিয়া একটা হাসি বহিয়া গেল ?” স্ত্রী হাসিয়া কহিলেন, “সে বুঝি হাসি ? সার বাধিয়া দীর্ঘ একঝাক পাখি উড়িয়া গেল, তাহাদেরই পাখার শব্দ শুনিয়াছিলাম। তুমি এত অল্পেই ভয় পাও ?” দিনের বেলায় স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম, পাখির বঁাক উড়িবার শব্দই বটে, এই সময়ে উত্তরদেশ হইতে হংসশ্রেণী নদীর চরে চরিবার জন্য আসিতেছে । কিন্তু সন্ধ্যা হইলে সে বিশ্বাস রাখিতে পারিতাম না | তখন মনে হইত, চারি দিকে সমস্ত অন্ধকার ভরিয়া ঘন হাসি জমা হইয়া রহিয়াছে, সামান্য একটা উপলক্ষে হঠাৎ আকাশ ভরিয়া অন্ধকার বিদীর্ণ করিয়া ধ্বনিত হইয়া উঠিবে। অবশেষে এমন হইল, সন্ধ্যার পর মনোরমার সহিত একটা কথা বলিতে আমার সাহস হইত না । অগ্রহায়ণ মাসে নদীর বাতাসে সমস্ত ভয় চলিয়া গেল। কয়দিন বড়ো সুখে ছিলাম । চারি দিকের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হইয়া মনোরমাও যেন তাহার হৃদয়ের রুদ্ধ দ্বার অনেকদিন পরে ধীরে ধীরে আমার নিকট খুলিতে লাগিল । গঙ্গা ছাড়াইয়া খড়ে ছাড়াইয়া অবশেষে পদ্মায় আসিয়া পৌছিলাম। ভয়ংকরী পদ্মা তখন হেমন্তের