পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V)\OO রবীন্দ্র-রচনাবলী হইতেছিল না ; কৰ্ণহীন নীেকার মতো ক্রমাগতই ঘুর খাইয়া মরিতেছিল ; অবশেষে অশ্রাতরঙ্গে ডুবি শরৎ কহিলেন, “ডাক্তার বলিতেছে, আর কিছুদিন থাকিয়া গেলে ভালো হয় ।” কিরণ কহিলেন, “তোমার ডাক্তার তো সব জানে !” শরৎ কহিলেন, “জান তো, এই সময়ে দেশে নানাপ্রকার ব্যামোর প্রাদুর্ভাব হয়, অতএব আর মাস দুয়েক কাটাইয়া গেলেই ভালো হয় ।” কিরণ কহিলেন, “এখানে এখন বুঝি কোথাও কাহারও কোনো ব্যামো হয় না ।” পূর্ব ইতিহাসটা এই। কিরণকে তাহার ঘরের এবং পাড়ার সালেই ভালোবাসে, এমন-কি, শাশুড়ি পর্যন্ত । সেই কিরণের যখন কঠিন পীড়া হইল। তখন সকলেই চিন্তিত হইয়া উঠিল, এবং ডাক্তার যখন বায়ুপরিবর্তনের প্রস্তাব করিল, তখন গৃহ এবং কাজকর্ম ছাড়িয়া প্রবাসে যাইতে তাহার স্বামী এবং শাশুড়ি কোনো আপত্তি করিলেন না । যদিও গ্রামের বিবেচক প্রাজ্ঞ ব্যক্তিমাত্ৰেই, বায়ুপরিবর্ত আরোগ্যের আশা করা এবং স্ত্রীর জন্য এতটা হুলস্থূল করিয়া তোলা, নব্য স্ত্ৰৈণতার একটা নির্লজ্জ আতিশয্য বলিয়া স্থির করিলেন এবং প্রশ্ন করিলেন, ইতিপূর্বে কি কাহারও স্ত্রীর কঠিন পীড়া হয় নাই, শরৎ যেখানে যাওয়া স্থির করিয়াছেন সেখানে কি মানুষরা অমর, এবং এমন কোনো দেশ আছে কি যে অদৃষ্ট্রের লিপি সফল হয় না— তথাপি শরৎ এবং তাহার মা সে-সকল কথায় কৰ্ণপাত করিলেন না ; তখন গ্রামের সমস্ত সমবেত বিজ্ঞতার অপেক্ষা তাহাদের হৃদয়লক্ষ্মী কিরণের প্রাণটুকু তাহাদের নিকট গুরুতর বোধ হইল । প্ৰিয়ব্যক্তির বিপদে মানুষের এরূপ মোহ ঘটিয়া থাকে । শরৎ চন্দননগরের বাগানে আসিয়া বাস করিতেছেন, এবং কিরণও রোগমুক্ত হইয়াছেন, কেবল শরীর এখনো সম্পূর্ণ সবল হয় নাই। তাহার মুখে চক্ষে একটি সকরুণ কৃশতা অঙ্কিত হইয়া আছে, যাহা দেখিলে হৃৎকম্পসহ মনে উদয় হয়, আহা বড়ো রক্ষা পাইয়াছে ! কিন্তু কিরণের স্বভাবটা সঙ্গপ্রিয়, আমোদপ্ৰিয় । এখানে একলা আর ভালো লাগিতেছে না ; তাহার ঘরের কাজ নাই, পাড়ার সঙ্গিনী নাই ; কেবল সমস্ত দিন আপনার রুগণ শরীরটাকে লইয়া নাড়াচাড়া করিতে মন যায় না । ঘণ্টায় ঘণ্টায় দাগ মাপিয়া ঔষধ খাও, তাপ দাও, পথ্য পালন করো, ইহাতে উপস্থিত হইয়াছিল । কিরণ যতক্ষণ উত্তর দিতেছিল। ততক্ষণ উভয়পক্ষে সমকক্ষভাবে দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলিতেছিল, কিন্তু অবশেষে কিরণ যখন নিরুত্তর হইয়া বিনা প্রতিবাদে শরতের দিক হইতে ঈষৎ বিমুখ হইয়া ঘাড় বঁাকাইয়া বসিল তখন দুর্বল নিরুপায় পুরুষটির আর কোনো অস্ত্র রহিল না। পরাভব স্বীকার করিবার উপক্ৰম করিতেছে, এমন সময় বাহির হইতে বেহাৱা উচ্চৈঃস্বরে কী একটা নিবেদন করিল। শরৎ উঠিয়া দ্বার খুলিয়া শুনিলেন, নীেকাডুবি হইয়া একটি ব্ৰাহ্মণবালক সাতার দিয়া তঁহাদের বাগানে আসিয়া উঠিয়াছে । শুনিয়া কিরণের মান-অভিমান দূর হইয়া গেল, তৎক্ষণাৎ আলনা স্বইতে শুষ্কবাস্ত্ৰ বাহির করিয়া দিলেন এবং শীঘ্র একবাটি দুধ গরম করিয়া ব্ৰাহ্মণের ছেলেকে অন্তঃপুরে ডাকিয়া পাঠাইলেন । ছেলেটির লম্বা চুল, বড়ো বড়ো চােখ, গোফের রেখা এখনো উঠে নাই। কিরণ তাহাকে নিজে থাকিয়া ভোজন করাইয়া তাহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন । শুনিলেন, সে যাত্রার দলের ছোকরা, তাহার নাম নীলকান্ত । তাহারা নিকটবতী সিংহবাবুদের বাড়ি যাত্রার জন্য আহূত হইয়াছিল ; ইতিমধ্যে নীেকাডুবি হইয়া তাহাদের দলের লোকের কী গতি হইল কে জানে ; সে ভালো সাতার জানিত, কোনোমতে প্রাণরক্ষা করিয়াছে । ছেলেটি এইখানেই রহিয়া গেল। আর একটু হইলেই সে মারা পড়িত, এই মনে করিয়া তাহার কিরণের অত্যন্ত দয়ার উদ্রেক হইল । শরৎ মনে করিলেন, হইল ভালো, কিরণ একটা নূতন কাজ হাতে পাইলেন, এখন কিছুকাল