পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

vow S. রবীন্দ্র-রচনাবলী অব্যাহতভাবে আপন কাজ করিতে লাগিল । সে এতদিন যে একটা বয়ঃসন্ধিস্থলে অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘকাল থামিয়া ছিল এখানে আসিয়া সেটা কখন একসময় নিঃশব্দে পাের হইয়া গেল । তাহার সতেরো-আঠারো বৎসরের বয়ঃক্রম বেশ সম্পূর্ণভাবে পরিণত হইয়া উঠিল । তাহার সে পরিবর্তন বাহির হইতে কাহারও চোখে পড়িল না। কিন্তু তাহার প্রথম লক্ষণ এই যে, যখন কিরণ নীলকাস্তের প্রতি বালকযোগ্য ব্যবহার করিতেন সে মনে মনে লজ্জিত এবং ব্যথিত হইত । একদিন আমোদপ্ৰিয় কিরণ তাহাকে স্ত্রীবেশে সখী সাজিবার কথা বলিয়াছিলেন, সে-কথাটা অকস্মাৎ তাহার বড়োই কষ্টদায়ক লাগিল অথচ তাহার উপযুক্ত কারণ খুঁজিয়া পাইল না । আজকাল তাহাকে যাত্রার অনুকরণ করিতে ডাকিলেই সে অদৃশ্য হইয়া যাইত। সে যে একটা লক্ষ্মীছাড়া যাত্রার দলের ছোকরার অপেক্ষা অধিক কিছু নয়। এ কথা কিছুতে তাহার মনে লাইত না । এমন-কি, সে বাড়ির সরকারের নিকট কিছু কিছু করিয়া লেখাপড়া শিখিবার সংকল্প করিল। কিন্তু বউঠাকরুনের স্নেহভাজন বলিয়া নীলকাস্তকে সরকার দুই চক্ষে দেখিতে পারিত না, এবং মনের একাগ্ৰতা রক্ষা করিয়া পড়াশুনা কোনোকালে অভ্যাস না থাকাতে অক্ষরগুলো তাহার চোখের সামনে দিয়া ভাসিয়া যাইত । গঙ্গার ধারে চাপাতলায় গাছের গুড়িতে ঠেসান দিয়া কোলের উপর বই খুলিয়া সে দীর্ঘকাল বসিয়া থাকিত ; জল ছল ছল করিত, নৌকা ভাসিয়া যাইত, শাখার উপরে চঞ্চল * অন্যমনস্ক পাখি কিচু মিচ শব্দে স্বাগত উক্তি প্ৰকাশ করিত, নীলকান্ত বইয়ের পাতায় চক্ষু রাখিয়া কী ভাবিত সেই জানে অথবা সেও জানে না । একটা কথা হইতে কিছুতেই আর-একটা কথায় গিয়া পৌছিতে পারিত না, অথচ বই পড়িতেছি মনে করিয়া তাহার ভারি একটা আত্মগৌরব উপস্থিত হইত । সামনে দিয়া যখন একটা নীেকা যাইত তখন সে আরো অধিক আড়ম্বরের সহিত বইখানা তুলিয়া বিড় বিড় করিয়া পড়ার ভান করিত ; দর্শক চলিয়া গেলে সে আর পড়ার উৎসাহ রক্ষা করিতে পারিত ୩ | | পূর্বে সে অভ্যস্ত গানগুলো যন্ত্রের মতো যথানিয়মে গাহিয়া যাইত, এখন সেই গানের সুরগুলো তাহার মনে এক অপূর্ব চাঞ্চলা সঞ্চার করে । গানের কথা অতি যৎসামান্য, তুচ্ছ অনুপ্ৰাসে পরিপূর্ণ, তাহার অর্থও নীলকান্তের নিকট সম্যক বোধগম্য নহে, কিন্তু যখন সে গাহিত ওরে রাজহংস, জন্মি দ্বিজবংশে এমন নৃশংস। কেন হলি রে— বল কী জন্যে, এ অরণ্যে, রাজকন্যের প্রাণসংশয় করিলি রে— তখন সে যেন সহসা লোকান্তরে জন্মান্তরে উপনীত হইত, তখন চারি দিকের অভ্যস্ত জগৎটা এবং তাহার তুচ্ছ জীবনটা গানে তৰ্জমা হইয়া একটা নূতন চেহারা ধারণ করিত। রাজহংস এবং রাজকন্যার কথা হইতে তাহার মনে এক অপরূপ ছবির আভাস জাগিয়া উঠিত, সে আপনাকে কী মনে করিত স্পষ্ট করিয়া বলা যায় না, কিন্তু যাত্রার দলের পিতৃমাতৃহীন ছোকরা বলিয়া ভুলিয়া যাইত । নিতান্ত অকিঞ্চনের ঘরের হতভাগ্য মলিন শিশু যখন সন্ধ্যাশয্যায় শুইয়া রাজপুত্র রাজকন্যা এবং সাত রাজার ধন মানিকের কথা শোনে, তখন সেই ক্ষীণদীপালোকিত জীর্ণ গৃহকোণের অন্ধকারে তাহার মনটা সমস্ত দারিদ্র্য ও হীনতার বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া এক সর্বসম্ভব রূপকথার রাজ্যে একটা নূতন রূপ, উজ্জ্বল বেশ এবং অপ্ৰতিহত ক্ষমতা ধারণ করে ; সেইরূপ গানের সুরের মধ্যে এই যাত্রার দলের ছেলেটি আপনাকে এবং আপনার জগৎটিকে একটি নবীন আকারে সৃজন করিয়া তুলিত— জলের ধ্বনি, পাতার শব্দ, পাখির ডাক এবং যে লক্ষ্মী এই লক্ষ্মীছাড়াকে আশ্রয় দিয়াছেন তাহার সহস্য স্নেহমুখচ্ছবি, র্তাহার কল্যাণমণ্ডিত বলয়বেষ্টিত বাহু দুইখানি এবং দুর্লভ সুন্দর পুষ্পদলকোমল রক্তিম চরণযুগল কী এক মায়ামন্ত্রবলে রাগিণীর মধ্যে রূপান্তরিত হইয়া যাইত । আবার একসময় এই গীতিমরীচিকা কোথায় অপসারিত হইত, যাত্রার দলের নীলকান্ত ঝাঁকড়া চুল লইয়া প্ৰকাশ পাইত,