পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ MSON) আমবাগানের অধ্যক্ষ প্ৰতিবেশীর অভিযোগক্রমে শরৎ আসিয়া তাহার গালে ঠাস ঠাস করিয়া চড় কষাইয়া দিতেন, এবং বালক-ভক্তমণ্ডলীর অধিনায়ক হইয়া নীলকান্ত জলে স্থলে এবং তরুশাখাগ্রে নব নব উপদ্রব সৃজন করিতে বাহির হইত । ইতিমধ্যে শরতের ভাই সতীশ কলিকতা-কলেজের ছুটিতে বাগানে আসিয়া আশ্রয় লইল । কিরণ ভারি খুশি হইলেন, তাহার হাতে আর-একটি কাজ জুটিল ; উপবেশনে আহারে আচ্ছাদনে সমবয়স্ক ঠাকুরপোর প্রতি পরিহাসপাশ বিস্তার করিতে লাগিলেন । কখনো হাতে সিঁদুর মাখিয়া তাহার চােখ টিপিয়া ধরেন, কখনো তাহার জামার পিঠে বান্দর লিখিয়া রাখেন, কখনো বানাৎ করিয়া বাহির হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়া সুললিত উচ্চহাস্যে পলায়ন করেন । সতীশও ছাড়িবার পাত্র নহে ; সে তাহার চাবি চুরি করিয়া, তাহার পানের মধ্যে লঙ্কা পুরিয়া, অলক্ষিতে খাটের খুরার সহিত তাহার আঁচল বাধিয়া প্রতিশোধ তুলিতে থাকে । এইরূপে উভয়ে সমস্তদিন তর্জন ধাবন হাস্য, এমন-কি, মাঝে মাঝে কলহ, ক্ৰন্দন, সাধাসাধি এবং পুনরায় শাস্তিস্থাপন চলিতে লাগিল । নীলকান্তকে কী ভূতে পাইল কে জানে। সে কী উপলক্ষ করিয়া কাহার সহিত বিবাদ করিবে ভাবিয়া পায় না, অথচ তাহার মন তীব্র তিক্তরসে পরিপূর্ণ হইয়া গেল । সে তাহার ভক্ত বালকগুলিকে অন্যােয়রূপে কাদাইতে লাগিল, তাহার সেই পোষা দিশি কুকুরটাকে অকারণে লাথি মারিয়া কেঁই কেই শব্দে নভোমণ্ডল ধ্বনিত করিয়া তুলিল, এমন-কি, পথে ভ্ৰমণের সময় সবেগে ছড়ি মারিয়া আগাছগুলার শাখাচ্ছেদন করিয়া চলিতে লাগিল । যাহারা ভালো খাইতে পারে, তাহাদিগকে সম্মুখে বসিয়া খাওয়াইতে কিরণ অত্যন্ত ভালোবাসেন । ভালো খাইবার ক্ষমতােটা নীলকাস্তের ছিল, সুখাদ্য দ্রব্য পুনঃপুনঃ খাইবার অনুরোধ তাহার নিকট কদাচ বাৰ্থ হইত না । এইজন্য কিরণ প্ৰায় তাহাকে ডাকিয়া লইয়া নিজে থাকিয়া খাওয়াইতেন, এবং এই ব্রাহ্মণবালকের তৃপ্তিপূর্বক আহার দেখিয়া তিনি বিশেষ সুখ অনুভব করিতেন । সতীশ আসার পরে এরূপ ঘটনায় তাহার ভোজনের কিছুমাত্র ব্যাঘাত হইত না, সে সর্বশেষে দুধের বাটি ধুইয়া তাহার জলসুদ্ধ খাইয়া। তবে উঠিত— কিন্তু আজকাল কিরণ নিজে ডাকিয়া না খাওয়াইলে তাহার বক্ষ ব্যথিত, তাহার মুখ বিস্বাদ হইয়া উঠিত, না খাইয়া উঠিয়া পড়িত ; বাস্পরুদ্ধকণ্ঠে দাসীকে বলিয়া যাইত, আমার ক্ষুধা নাই। মনে করিত, কিরণ সংবাদ পাইয়া এখনি অনুতপ্তচিত্তে তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইবেন, এবং খাইবার জন্য বারংবার অনুরোধ করিবেন, সে তথাপি কিছুতেই সে অনুরোধ পালন করিবে না, বলিবে, আমার ক্ষুধা নাই । কিন্তু কিরণকে কেহ সংবাদও দেয় না, কিরণ তাহাকে ডাকিয়াও পাঠান না ; খাবার যাহা থাকে দাসী খাইয়া ফেলে । তখন সে আপন শয়নগৃহের প্রদীপ নিবাইয়া দিয়া অন্ধকার বিছানার উপর পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া ফাপিয়া ফাপিয়া মুখের উপর সবলে বালিশ চাপিয়া ধরিয়া কাদিতে থাকে ; কিন্তু কী তাহার নালিশ, কাহার উপরে তাহার দাবি, কে তাহাকে সাস্তুনা করিতে আসিবে ! যখন কেহই আসে না, তখন স্নেহময়ী বিশ্বধাত্রী নিদ্ৰা আসিয়া ধীরে ধীরে কোমলকর স্পর্শে এই মাতৃহীন ব্যথিত বালকের অভিমান শান্ত করিয়া দেন । নীলকান্তের দৃঢ় ধারণা হইল, সতীশ কিরণের কাছে তাহার নামে সর্বদাই লাগায় ; যেদিন কিরণ কোনো কারণে গভীর হইয়া থাকিতেন সেদিন নীলকান্ত মনে করিত, সতীশের চক্রান্তে কিরণ তাহারই উপর রাগ করিয়া আছেন । এখন হইতে নীলকান্ত একমনে তীব্ৰ আকাঙক্ষার সঙ্গে সর্বদাই দেবতার নিকট প্রার্থনা করে, আর-জন্মে। আমি যেন সতীশ হই। এবং সতীশ যেন আমি হয় ।” সে জানিত, ব্ৰাহ্মণের একান্ত মনের অভিশাপ কখনো নিম্বফল হয় না, এইজন্য সে মনে মনে সতীশকে ব্ৰহ্মতেজে দগ্ধ করিতে গিয়া নিজে দগ্ধ হইতে থাকিত, এবং উপরের তলা হইতে সতীশ ও তাহার বউঠাকুরানীর উচ্ছসিত উচ্চহাস্যমিশ্রিত পরিহাসকলরব শুনিতে পাইত । নীলকান্ত স্পষ্টত সতীশের কোনোরূপ শক্ৰতা করিতে সাহস করিত না, কিন্তু সুযোগমত তাহার