পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\O\S)8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ছোটােখাটাে অসুবিধা ঘটাইয়া প্রীতিলাভ করিত । ঘাটের সোপানে সাবান রাখিয়া সতীশ যখন গঙ্গায় নামিয়া ডুব দিতে আরম্ভ করিত তখন নীলকান্ত ফস করিয়া আসিয়া সাবান চুরি করিয়া লইত ; সতীশ যথাকলে সাবানের সন্ধানে আসিয়া দেখিত, সাবান নাই । একদিন নাহিতে নাহিতে হঠাৎ দেখিল তাহার বিশেষ শখের চিকানোর-কাজ-করা জামাটি গঙ্গার জলে ভাসিয়া যাইতেছে ; ভাবিল, হাওয়ায় উড়িয়া গেছে, কিন্তু হাওয়াটা কোন দিক হইতে বহিল। তাহা কেহ জানে না। একদিন সতীশকে আমোদ দিবার জন্য কিরণ নীলকান্তকে ডাকিয়া তাহাকে যাত্রার গান গাহিতে বলিলেন ; নীলকান্ত নিরুত্তর হইয়া রহিল ; কিরণ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোর আবার কী হল রে।” নীলকান্ত তাহার জবাব দিল না। কিরণ পুনশ্চ বলিলেন, “সেই গানটা গা-না।” “সে আমি ভুলে গেছি” বলিয়া নীলকান্ত চলিয়া গেল । অবশেষে কিরণের দেশে মার্ক ‘কবার সময় হইল । সকলেই প্ৰস্তুত হইতে লাগিল ; সতীশও সঙ্গে যাইবে । কিন্তু নীলকান্তকে হে কোনো কথাই বলে না । সে সঙ্গে যাইবে কি থাকিবে, সে প্রশ্নমাত্র কাহারও মনে উদয় হয় না । কিরণ নীলকান্তকে সঙ্গে লইবার প্রস্তাব করিলেন। তাহাতে শাশুড়ি স্বামী এবং দেবর সকলেই একবাক্যে আপত্তি করিয়া উঠিলেন, কিরণও তাহার সংকল্প ত্যাগ করিলেন । অবশেষে যাত্রার দুই দিন আগে ব্ৰাহ্মণবালককে ডাকিয়া কিরণ তাহাকে মেহবাক্যে স্বদেশে যাইতে উপদেশ করিলেন । সে উপরি উপরি কয়দিন অবহেলার পর মিষ্টবাক্য শুনিতে পাইয়া আর থাকিতে পারিল না, একেবারে কাদিয়া উঠিল। কিরণেরও চােখ ছলছল করিয়া উঠিল ; যাহাকে চিরকাল কাছে রাখা যাইবে না। তাহাকে কিছুদিন আদর দিয়া তাহার মায়া বসিতে দেওয়া ভালো হয় নাই বলিয়া কিরণের মনে বড়ো অনুতাপ উপস্থিত হইল । সতীশ কাছে উপস্থিত ছিল ; সে অতবড়ো ছেলের কান্না দেখিয়া ভারি বিরক্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, “আরো মোলো, কথা নাই বার্তা নাই, একেবারে কাদিয়াই অস্থির !” কিরণ এই কঠোর উক্তির জন্য সতীশকে ভৎসনা করিলেন । সতীশ কহিল, “তুমি বোঝা না বউদিদি, তুমি সকলকেই বড়ো বেশি বিশ্বাস করো ; কোথাকার কে তাহার ঠিক নাই, এখানে আসিয়া দিব্য রাজার হালে আছে। আবার পুনমূষিক হইবার আশঙ্কায় আজ মায়াকান্না জুডিয়াছে— ও বেশ জানে যে, দুফোটা চোখের জল ফেলিলেই তুমি গলিয়া যাইবে ।” নীলকান্ত তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল ; কিন্তু তাহার মনটা সতীশের কাল্পনিক মূর্তিকে ছুরি হইয়া কাটিতে লাগিল, ছুচ হইয়া বিধিতে লাগিল, আগুন হইয়া জ্বালাইতে লাগিল, কিন্তু প্রকৃত সতীশের গায়ে একটি চিহ্নমাত্র বসিল না, কেবল তাহারই মর্মস্থল হইতে রক্তপাত হইতে লাগিল । । ঝিনুকের নীেকার উপর দোয়াত বসানাে এবং মাঝে একটা জর্মন রৌপ্যের হাস উন্মুক্ত চঞ্চপুটে কলম লইয়া পাখা মেলিয়া বসিয়া আছে, সেটির প্রতি সতীশের অত্যন্ত যতু ছিল ; প্রায় সে মাঝে মাঝে সিঙ্কের রুমাল দিয়া অতি সযত্নে সেটি ঝাড়পোচ করিত । কিরণ প্রায়ই পরিহাস করিয়া সেই রৌপ্যহংসের চঞ্চ-অগ্রভাগে অঙ্গুলির আঘাত করিয়া বলিতেন, “ওরে রাজহংস, জন্মি দ্বিজবংশে এমন নৃশংস। কেন হলি রে” এবং ইহাই উপলক্ষ করিয়া দেবরে তঁহাতে হাস্যকৌতুকে বাগযুদ্ধ চলিত । স্বদেশীযাত্রার আগের দিন সকালবেলায় সে জিনিসটা খুঁজিয়া পাওয়া গেল না । কিরণ হাসিয়া কহিলেন, “ঠাকুরপো, তোমার রাজহংস তোমার দময়ন্তীর অন্বেষণে উড়িয়াছে।” কিন্তু সতীশ অগ্নিশৰ্মা হইয়া উঠিল। নীলকান্তই যে সেটা চুরি করিয়াছে সে-বিষয়ে তাহার সন্দেহম এ রহিল না— গতকল্য সন্ধ্যার সময় তাহাকে সতীশের ঘরের কাছে ঘুর ঘুর করিতে দেখিয়ছে, এমন সাক্ষীও পাওয়া গেল। সতীশের সম্মুখে অপরাধী আনীত হইল। সেখানে কিরণও উপস্থিত ছিলেন । সতীশ একেবারেই তাহাকে বলিয়া উঠিলেন, “তুই আমার দোয়াত চুরি করে কোথায় রেখেছিস, এনে দে৷ ”