পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VbG SR রবীন্দ্র-রচনাবলী শুরু ভোজনটা কিছু নয় ।” যখন বৃষ্টি পড়িত তখন ঠাকুরদাকে কেহ তাহার প্রতিজ্ঞা স্মরণ করাইয়া দিত না ; বরঞ্চ কথা উঠিলে সকলে বলিত, “এই বৃষ্টিবাদলটা না ছাড়লে সুবিধে হচ্ছে না ।” ক্ষুদ্র বাসাবাড়িতে বাস করাটা তাহার পক্ষে ভালো দেখাইতেছে না এবং কষ্টও হইতেছে। এ কথা তাহার বন্ধুবান্ধব সকলেই তাহার সমক্ষে স্বীকার করিত, অথচ কলিকাতায় কিনিবার উপযুক্ত বাড়ি খুঁজিয়া পাওয়া যে কত কঠিন। সে বিষয়েও কাহাৱো সন্দেহ ছিল না- এমন-কি, আজ ছয়-সাত বৎসর সন্ধান করিয়া ভাড়া লইবার মতো একটা বড়ো বাড়ি পাড়ার কেহ দেখিতে পাইল না- অবশেষে ঠিাকুরদামশায় বলিতেন, “তা হােক ভাই, তোমাদের কাছাকাছি আছি। এই আমার সুখ । নয়নজোড়ে-বড়ো বাড়ি তো পড়েই আছে, কিন্তু সেখানে কি মন টেকে ৷” আমার বিশ্বাস, ঠাকুরদাও জানিতেন যে সকলে তাহার অবস্থা জানে এবং যখন তিনি ভূতপূর্ব নয়নজোড়কে বর্তমান বলিয়া ভান করিতেন এবং অন্য সকলেও তাহতে যোগ দিত। তখন তিনি মনে মনে বুঝিতেন যে, পরস্পরের এই ছলনা কেবল পরস্পরের প্রতি সৌহাৰ্দবশত । কিন্তু আমার বিষম বিরক্তি বোধ হইত । অল্পবয়সে পরের নিরীহ গৰ্ব্বও দমন করিতে ইচ্ছা করে এবং সহস্ৰ শুরুতর অপরাধের তুলনায় নিবুদ্ধিতাই সর্বাপেক্ষা অসহ্য বোধ হয় । কৈলাসবাবু ঠিক নির্বোধি ছিলেন না, কাজে কর্মে তাহার সহায়তা এবং পরামর্শ সকলেই প্রার্থনীয় জ্ঞান করিত । কিন্তু নয়নজোড়ের গৌরব প্ৰকাশ সম্বন্ধে তাহার কিছুমাত্ৰ কাণ্ডজ্ঞান ছিল না । সকলে তাহাকে ভালোবাসিয়া এবং আমোদ করিয়া তাহার কোনো অসম্ভব কথাতেই প্ৰতিবাদ করিত না বলিয়া তিনি আপনার কথার পরিমাণ রক্ষা করিতে পারিতেন না । অন্য লোকেও যবন আমোদ করিয়া অথবা তাহাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য নয়ন জোড়ের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে বিপরীত মাত্রায় অতু্যক্তি প্রয়োগ করিত তিনি অকাতরে সমস্ত গ্ৰহণ করিতেন এবং স্বপ্নেও সন্দেহ করিতেন না যে, অন্য কেহ এ-সকল কথা লেশমাত্র অবিশ্বাস করিতে পাৱে । আমার এক-এক সময় ইচ্ছা করিত, বৃদ্ধ যে মিথ্যা দুর্গ অবলম্বন করিয়া বাস করিতেছে এবং মনে করিতেছে ইহা চিরস্থায়ী, সেই দুর্গটি দুই তোপে সর্বসমক্ষে উড়াইয়া দিই। একটা পাখিকে সুবিধামত ডালের উপর বসিয়া থাকিতে দেখিলেই শিকারির ইচ্ছা করে তাহাকে গুলি বসাইয়া দিতে, পাহাড়ের গড়াইয়া ফেলিতে- যে জিনিসটা প্ৰতি মুহুর্তে পড়ি-পড়ি করিতেছে অথচ কোনো একটা কিছুতে সংলগ্ন হইয়া আছে, তাহকে ফেলিয়া দিলেই তবে যেন তাহার সম্পর্ণিতা-সাধন এবং দর্শকের মনে তৃপ্তিলাভ হয় । কৈলাসবাবুর মিথ্যাগুলি এতই সরল, তাহার ভিত্তি এতই দুর্বল, তাহা ঠিক সত্য-বন্দুকের লক্ষ্যের সামনে এমনি বুক ফুলাইয়া নৃত্য করিত যে, তাহাকে মুহুর্তের মধ্যে বিনাশ করিবার জন্য একটি আবেগ উপস্থিত হইত- কেবল নিতান্ত আলস্যবশত এবং সর্বজনসম্মত প্রথার অনুসরণ করিয়া সে কার্যে হস্তক্ষেপ করিতাম না । দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ নিজের অতীত মনোভাব বিশ্লেষপ করিয়া যতটা মনে পড়ে তাহতে বোধ করি, কৈলাসবাকুর প্রতি আমার আন্তরিক বিদ্বেষের আর-একটি গৃঢ় কারণ ছিল । তাহা একটু বিবৃত করিয়া বলা আবশ্যক । আমি বড়োমানুষের ছেলে হইয়াও যথাকলে এম. এ. পাস করিয়াছি, যৌবন সত্বেও কোনোপ্রকার কুসংসর্গ কুৎসিত-আমোদে যোগ দিই নাই, এবং অভিভাবকদের মৃত্যুর পরে স্বয়ং কর্তা হইয়াও আমার স্বভাবের কোনোপ্রকার বিকৃতি উপস্থিত হয় নাই । তাহ ছাড়া চেহারাটা এমন যে, তাহকে আমি নিজমুখে সুশ্ৰী বলিলে অহংকার হইতে পারে, কিন্তু মিথ্যাবাদ হয় না ।