পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

53B OG wo অতএব বাংলাদেশে ঘটকালির হাটে আমার দাম যে অত্যন্ত বেশি তাহাতে আর সন্দেহ নাই- এই হাটে আমার সেই দাম আমি পুরা আদায় করিয়া লইব, এইরূপ দৃঢ়প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছিলাম। ধনী পিতার লাগিল । আমি অবিচলিতচিত্তে নিক্তি ধরিয়া তাহদের যোগ্যতা ওজন করিয়া লইতেছিলাম, কোনোটাই আমার সমযোগ্য বোধ হয় নাই। অবশেষে ভবভূতির ন্যায় আমার ধারণা হইয়াছিল যে কিন্তু বর্তমান কালে এবং ক্ষুদ্র বঙ্গদেশে সেই অসম্ভব দুর্লভ- পদার্থ জমিয়াছে কি না সন্দেহ । লাগিল । কন্যা পছন্দ হউক বা না হউক, এই পূজা আমার মন্দ লাগিত না । ভালো ছেলে বলিয়া কন্যার পিতৃগণের এই পূজা আমার উচিত প্ৰাপ্য স্থির করিয়াছিলাম । শাস্ত্রে পড়া যায়, দেবতা বর দিন আর না দিন, যথাবিধি পূজা না পাইলে বিষম ক্রুদ্ধ হইয়া উঠেন । নিয়মিত পূজা পাইয়া আমারও মনে সেইরূপ অতু্যচ্চ দেবভােব জন্মিায়াছিল । পূর্বেই বলিয়ছিলাম, ঠাকুরদামশায়ের একটি পৌত্রী ছিল । তাহাকে অনেকবার দেখিয়াছি, কিন্তু কখনো রূপবতী বলিয়া ভ্ৰম হয় নাই । সুতরাং তাহাকে বিবাহ করিবার কল্পনাও আমার মনে উদিত হয়। নাই । কিন্তু ইহা ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলাম যে, কৈলাসবাবু লোক মারফত অথবা স্বয়ং পৌত্রীটিকে অৰ্ঘ্য দিবার মানসে আমার পূজার বোধন করিতে আসিবেন, কারণ আমি ভালো ছেলে । কিন্তু তিনি তাহা করিলেন না । শুনিতে পাইলাম, আমার কোনো বন্ধুকে তিনি বলিয়াছিলেন, নয়নজোড়ের বাবুরা কখনো কোনো বিষয়ে অগ্রসর হইয়া কাহারো নিকটে প্রার্থনা করে নাই- কন্যা যদি চিরকুমারী হইয়া থাকে তথাপি সে কুলপ্ৰথা তিনি ভঙ্গ করিতে পরিবেন না । শুনিয়া আমার বড়ো রাগ হইল । সে রাগ অনেক দিন পর্যন্ত আমার মনের মধ্যে ছিল ; কেবল ভালো ছেলে বলিয়াই চুপচাপ করিয়া ছিলাম । যেমন বজের সঙ্গে বিদ্যুৎ থাকে, তেমনি আমার চরিত্রে রাগের সঙ্গে সঙ্গে একটা কৌতুকপ্রিয়তা জড়িত ছিল । বুদ্ধকে শুদ্ধমাত্র নিপীড়ন করা আমার দ্বারা সম্ভব হইত না ; কিন্তু একদিন হঠাৎ এমন একটা কৌতুকাবহ প্ল্যান মাথায় উদয় হইল যে, সেটা কাজে খাটাইবার প্রলোভন সম্বরণ করিতে পারিলাম না । পূর্বেই বলিয়াছি, বৃদ্ধকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য নানা লোকে নানা মিথ্যা কথার সৃজন করিত । পাড়ার একজন পেনসনভোগী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট প্রায় বলিতেন, “ঠাকুরদা, ছোটােলাটের সঙ্গে যখনই দেখা হয়। তিনি নয়নজোড়ের বাবুদের খবর না নিয়ে ছাড়েন না- সাহেব বলেন, বাংলাদেশে, বর্ধমানের রাজা এবং নয়নজোড়ের বাবু, এই দুটি মাত্র যথাৰ্থ বনেদি বংশ আছে।” ঠাকুরদা ভারি খুশি হইতেন এবং ভূতপূর্ব ডেপুটিবাকুর সহিত সাক্ষাৎ হইলে অন্যান্য কুশলসংবাদের সহিত জিজ্ঞাসা করিতেন, “ছোটােলাট সাহেব ভালো আছেন ? তার মেমসাহেব ভালো আছেন ? তার পুত্রকন্যারা সকলেই ভালো আছেন ?” সাহেবের সহিত শীঘ্র একদিন সাক্ষাৎ করিতে যাইবেন এমন ইচ্ছাও প্রকাশ করিতেন । কিন্তু ভূতপূর্ব ডেপুটি নিশ্চয়ই জানিতেন, নয়নজোড়ের বিখ্যাত চৌধুড়ি প্রািত্তত হইয়া দ্বারে আসিতে আসিতে বিস্তর ছোটোলটি এবং বড়োলট বদল হইয়া যাইবে । আমি একদিন প্ৰাতঃকালে গিয়া কৈলাসবাবুকে আড়ালে ডাকিয়া লইয়া চুপিচুপি বলিলাম, আমি বললুম, নয়নজোড়ের কৈলাসবাবু কলকাতাতেই আছেন ; শুনে, হােটেলটি এতদিন দেখা