পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ 9( ) নয়নতারার বাপ নয়নকে সঙ্গে করিয়া তাহদের বাড়িতে আসিয়া বামাচরণের সহিত তাহার কন্যার বিবাহের জন্য গৌরীকান্তকে বিস্তর অনুনয়-বিনয় করিয়াছিলেন । " সেই উপলক্ষে ক্ষুদ্র বালিকা নয়নতারার অসামান্য প্ৰগলভ্যতায় গৌরীকান্তের অন্তঃপুরে সকলেই আশ্চর্য এবং কৌতুকান্বিত হইয়াছিলেন এবং তাহার সেই অকালপক্কতার নিকট মুখচোরা লাজুক ইন্দ্ৰাণী নিজেকে নিতান্ত অক্ষমা ৷ অনভিজ্ঞা জ্ঞান করিয়াছিল । গৌরীকান্ত এই মেয়েটির অনর্গল কথায় বার্তায় এবং চেহারায় বড়োই খুশি হইয়াছিলেন, কিন্তু কুলের যৎকিঞ্চিৎ ক্ৰটি থাকায় বামাচরণের সহিত ইহার বিবাহপ্রস্তাবে মত দিলেন না । অবশেষে তাহারই পছন্দে এবং তাঁহারই চেষ্টায় অকুলীন বিনোদের সহিত নয়নতারার বিবাহ হয় । এই-সকল কথা মনে করিয়া ইন্দ্ৰাণী কোনো সাস্তুনা পাইল না, বরং অপমান আরো বেশি করিয়া বাজিতে লাগিল । মহাভারতে বৰ্ণিত শুক্রাচার্যদুহিতা দেবযানী এবং শমিষ্ঠার কথা মনে পড়িল । দেবযানী যেমন তাহার প্রভুকন্যা শৰ্মিষ্ঠার দর্পচূৰ্ণ করিয়া তাহাকে দাসী করিয়াছিল, ইন্দ্ৰাণী যদি তেমনি করিতে পারিত তবেই যথোপযুক্ত বিধান হইত। এক সময় ছিল, যখন দৈত্যদের নিকট দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের ন্যায় মুকুন্দবাবুর পরিবারবর্গের নিকট তাহার পিতামহ গৌরীকান্ত একান্ত আবশ্যক ছিলেন । তখন তিনি যদি ইচ্ছা করিতেন। তবে মুকুন্দবাবুকে হীনতা স্বীকার করাইতে পারিতেন । কিন্তু । তিনিই মুকুন্দলালের বিষয়সম্পত্তিকে উন্নতির চরম সীমায় উত্তীৰ্ণ করিয়া দিয়া সর্বপ্রকার শৃঙ্খলা স্থাপন করিয়া গিয়াছেন, অতএব আজ আর তাহাকে স্মরণ করিয়া প্ৰভুদের কৃতজ্ঞ হইবার আবশ্যকতা নাই । ইন্দ্ৰাণী মনে করিল, বাকিগাড়ি পরগনা তাহার পিতামহ অনায়াসে নিজের জন্যই কিনিতে পারিতেন, তখন তাহার সে ক্ষমতা জন্মিয়াছিল, তাহা না করিয়া তিনি সেটা মনিবকে কিনিয়া দিলেন- ইহা যে একপ্রকার দান করা সে কথা কি আজ সেই মনিবের বংশে কেহ মনে করিয়া রাখিয়াছে । “আমাদেরই দত্ত ধনমানের গর্বে তোমরা আমাদিগকে আজ অপমান করিবার অধিকার পাইয়ােছ’ ইহাই মনে করিয়া ইন্দ্ৰাণীর চিত্ত ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল । বাড়ি ফিরিয়া ত্যাসিয়া সে দেখিল তাহার স্বামী প্ৰভুগৃহের নিমন্ত্রণ ও তাহার পরে জমিদারি কাগজ পাঠ করিতেছেন । অনেকের ধারণা আছে যে, স্বামী-স্ত্রীর স্বভাব প্রায়ই একরূপ হইয়া থাকে । তাহার কারণ, দৈবাৎ কোনো কোনো স্থলে স্বামী-স্ত্রীর স্বভাবের মিল দেখিতে পাইলে সেটা আমাদের নিকট এমন সমুচিত এবং সংগত বলিয়া বোধ হয় যে, আমরা আশা করি এই নিয়ম বুঝি অধিকাংশ স্থলেই খাটে । যাহা হউক, বর্তমান ক্ষেত্রে অম্বিকাচরণের সহিত ইন্দ্ৰাণীর দুই-একটা বিশেষ বিষয়ে বাস্তবিক স্বভাবের মিল দেখা যায়। অম্বিকাচরণ তেমন মিশক লোক নহেন । তিনি বাহিরে যান কেবলমাত্র কাজ করিতে । নিজের কাজ সম্পূর্ণ শেষ করিয়া এবং অন্যকে পুরামাত্রায় কাজ করাইয়া লইয়া বাড়ি আসিয়া যেন তিনি অনাত্মীয়তার আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিবার জন্য এক দুৰ্গম দুগের মধ্যে প্রবেশ করেন । বুকুরে ভূমি এবং উহার কর্তব্য কর্ম, ঘরের মধ্যে তিনি এবং উহার ইন্দ্ৰাণী, ইহাতেই গুহার সমস্ত পর্যাপ্ত । ভূষণের ছটা বিস্তার করিয়া যখন সুসজ্জিতা ইন্দ্ৰাণী ঘরে প্রবেশ করিলেন তখন অম্বিকাচরণ তাহাকে পরিহাস করিয়া কী একটা কথা বলিবার উপক্ৰম করিলেন, কিন্তু সহসা ক্ষান্ত হইয়া চিন্তিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার কী হয়েছে।” ইন্দ্ৰাণী তাহার সমস্ত চিন্তা হাসিয়া উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিয়া কহিলেন, “কী আর হবে । সম্প্রতি আমার স্বামিরত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে ।” অম্বিকা খবরের কাগজ ভূমিতলে ফেলিয়া দিয়া কহিলেন, “সে তো আমার অগোচর নেই। তৎপূর্বে ?” ইন্দ্ৰাণী একে একে গহনা খুলিতে খুলিতে বলিলেন, “তৎপূর্বে স্বামিনীর কাছ থেকে সমাদর লাভ হয়েছে ।”