পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

OVO রবীন্দ্র-রচনাবলী । অম্বিকা জিজ্ঞাসা করিলেন, “সমােদরটা কী রকমের।” ইন্দ্ৰাণী স্বামীর কাছে আসিয়া তাহার কেদারার হাতার উপর বসিয়া তাহার শ্ৰীবা বেষ্টন কবিয, উত্তর করিল, “তোমার কাছ থেকে যে রকমের পাই ঠিক সেই রকমের নয় ।” তাহার পর, ইন্দ্ৰাণী একে একে সকল কথা বলিয়া গেল । সে মনে করিয়াছিল স্বামীর কাছে এ-সকল অপ্ৰিয় কথার উত্থাপন করিবে না ; কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা হইল না এবং ইহার অনুরূপ প্ৰতিজ্ঞাও ইন্দ্ৰাণী ইতিপূর্বে কখনো রক্ষা করিতে পারে নাই। বাহিরের লোকের নিকট ইন্দ্ৰাণী যতই সংযত সমাহিত হইয়া থাকিত স্বামীর নিকটে সে সেই পরিমাণে আপন প্ৰকৃতির সমুদয় স্বাভাবিক বন্ধন মোচন করিয়া ফেলিত— সেখানে লেশমাত্র আত্মগোপন করিতে পারিত না । অম্বিকাচরণ সমস্ত ঘটনা শুনিয়া মর্মান্তিক ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন । বলিলেন, “এখনই আমি কাজে ইস্তফা দিব ।” তৎক্ষণাৎ তিনি বিনোদবাবুকে এক কড়া চিঠি লিখিতে উদ্যত হইলেন । ইন্দ্ৰাণী তখন চৌকির হাতা হইতে নীচে নামিয়া মাদুর-পাতা মেঝের উপর স্বামীর পায়ের কাছে বসিয়া তাহার কোলের উপর বাহু রাখিয়া বলিল, “এত তাড়াতাড়ি কাজ নেই । চিঠি আজ থাক । কাল সকালে যা হয় স্থির কোরো ।” অম্বিকা উত্তেজিত হইয়া উঠিয়া কহিলেন, “না, আর এক দণ্ড বিলম্ব করা উচিত নয় ।” ইন্দ্ৰাণী তাহার পিতামহের হৃদয়মৃণালে একটিমাত্র পদ্মের মতো ফুটিয়া উঠিয়াছিল । তাহার অন্তর হইতে সে যেমন মেহরস আকর্ষণ করিয়া লইয়াছিল। তেমনি পিতামহের চিত্তসঞ্চিত অনেকগুলি ভাব সে অলক্ষ্যে গ্ৰহণ করিয়াছিল । মুকুন্দলালের পরিবারের প্রতি গৌরীকান্তের যে-একটি অচল নিষ্ঠা ও ভক্তি ছিল ইন্দ্ৰাণী যদিও তাঁহা সম্পূর্ণ প্ৰাপ্ত হয় নাই, কিন্তু প্ৰভুপরিবারের হিতসাধনে জীবন অর্পণ করা যে তাহদের কর্তব্য এই ভাবটি তাহার মনে দৃঢ় বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছিল । তাহার সুশিক্ষিত স্বামী ইচ্ছা! করিলে ওকালতি করিতে পারিতেন, সম্মানজনক কাজ লইতে পারিতেন, কিন্তু তাহার স্ত্রীর হৃদয়ের দৃঢ় সংস্কার অনুসরণ করিয়া তিনি অনন্যমনে সন্তুষ্টচিত্তে বিনোদের বিষয়সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করিতেছিলেন । ইন্দ্ৰাণী যদিও অপমানে আহত হইয়াছিল, তথাপি তাহার স্বামী যে বিনোদবিহারীর কাজ ছাড়িয়া দিবে। এ তাহার কিছুতেই মনে লইল না । ইন্দ্ৰাণী তখন যুক্তির অবতারণা করিয়া মৃদুস্বরে মিষ্টস্বরে কহিল, “বিনোদবাবুর তো কোনো দোষ নেই, তিনি এর কিছুই জানেন না। তার স্ত্রীর উপর রাগ করে তুমি হঠাৎ তাড়াতাড়ি তার সঙ্গে ঝগড়া করতে যাবে কেন ।” শুনিয়া অম্বিকাবাবু উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিলেন ; নিজের সংকল্প তাহার নিকট অত্যন্ত হাস্যকর বলিয়া বোধ হইল । তিনি কহিলেন, “ সে একটা কথা বটে । কিন্তু মনিব হোন আর যিনিই হোন, ওদের ওখানে আর কখনো তোমাকে পাঠাচ্ছি নে ৷” এই অল্প একটু ঝড়েই সেদিনকার মতো মেঘ কাটিয়া গেল, গৃহ প্ৰসন্ন হইয়া উঠিল এবং স্বামীর বিশেষ আদরে ইন্দ্ৰাণী বাহিরের সমস্ত অনাদর বিস্মত হইয়া গেল । তৃতীয় পরিচ্ছেদ বিনোদবিহারী অম্বিকাচরণের উপর সম্পূর্ণ ভার দিয়া জমিদারির কাজ কিছুই দেখিতেন না । নিতান্তনির্ভর ও অতিনিশ্চয়তাবশত কোনাে কোনাে স্বামী ঘরের স্ত্রীকে যেরূপ অবহেলার চক্ষে দেখিয়া থাকে, নিজের জমিদারির প্রতিও বিনোদের কতকটা সেইভাবের উপেক্ষা ছিল । জমিদারির আয় এতই নিশ্চিত, এতই বাধা যে তাহাকে আয় বলিয়া বোধ হয় না, তাহা অভ্যন্ত, এবং তাহার কোনো আকর্ষণ ছিল না । বিনোদের ইচ্ছা ছিল, একটা সংক্ষেপ সুড়ঙ্গপথ অবলম্বন করিয়া হঠাৎ এক রাত্রির মধ্যে কুবেরের ভাণ্ডারের মধ্যে প্রবেশ করিবেন। সেইজন্য নানা লোকের পরামর্শে তিনি গোপনে নানাপ্রকার