পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গণ্ডছ VISNIN আজাগবি ব্যবসায়ে হস্তক্ষেপ করিতেন । কখনো স্থির হইত, দেশের সমস্ত বাবলা গাছ জমা লইয়া গোরুর গাড়ির চাকা তৈরি করাইবেন; কখনো পরামর্শ হইত, সুন্দরবনের সমস্ত মধুচক্র তিনি আহরণ কবিবেন ; কখনো লোক পঠাইয়া পশ্চিমপ্রদেশের বনগুলি বন্দোবস্ত করিয়া হরীতকীর ব্যবসায় একচেটে করিবার আয়োজন হইত। বিনোদ মনে মনে ইহা বুঝিতেন যে অন্য লোকে শুনিলে হাসিবে, সেইজন্য কাহারও কাছে প্ৰকাশ করিতে চাহিতেন না । বিশেষত অম্বিকাচরণকে তিনি একটু বিশেষ লজা করিতেন ; অম্বিকা পাছে মনে করেন। তিনি টাকাগুলো নষ্ট করিতে বসিয়াছেন, সেজন্য মনে মনে সংকুচিত ছিলেন । অম্বিকার নিকট তিনি এমনভাবে থাকিতেন যেন অম্বিকাই জমিদার এবং তিনি কেবল বসিয়া থাকিবার জন্য বার্ষিক কিছু বেতন পাইতেন । নিমন্ত্রণের পরদিন হইতে নয়নতারা তাহার স্বামীর কানে মন্ত্র দিতে লাগিলেন । “তুমি তো নিজে কিছুই দেখ না, তোমাকে অম্বিকা হাত তুলিয়া যাহা দেয় তাহাই তুমি শিরোধার্য করিয়া লাও ; এ দিকে ভিতরে ভিতরে কী সর্বনাশ হইতেছে তাহা কেহই জানে না । তোমার ম্যানেজারের স্ত্রী যা গয়না পরিয়া আসিয়াছিল এমন গয়না তোমার ঘরে আসিয়া আমি কখনো চক্ষেও দেখি নাই । এ-সব গয়না সে পায় কোথা হইতে এবং এত দেমাকই বা তাহার বাডিল কিসের জোরে” ইত্যাদি ইত্যাদি ৷ গহনার বর্ণনা নয়নতারা অনেকটা অতিরঞ্জিত করিয়া বলিল, এবং ইন্দ্ৰাণী নিজমুখে তাহার দাসীকে কী-সকল কথা বলিয়া গেছে তাহাও সে বহুল পরিমাণে রচনা করিয়া গেল । বিনোদ দুর্বল প্ৰকৃতির লোক ; এক দিকে সে পরের প্রতি নির্ভর না করিয়াও থাকিতে পারে না, অপর দিকে যে তাহার কানে যেরূপ সন্দেহ তুলিয়া দেয় সে তাহাই বিশ্বাস করিয়া বসে। ম্যানেজার যে চুরি করিতেছে মুহুর্তকালের মধ্যেই এ বিশ্বাস তাহার দৃঢ় হইল। বিশেষত কাজ সে নিজে দেখে না বলিয়া কল্পনায় সে নানাপ্রকার বিভীষিকা দেখিতে লাগিল। অথচ কেমন করিয়া ম্যানেজারের চুরি ধরিতে হইবে তাহারও রাস্তা সে জানে না। স্পষ্ট করিয়া তাহাকে কিছু বলিতে পারে এমন সাহস নাই । মহা মুশকিল হইল । অম্বিকাচরণের একাধিপত্যে কর্মচারীগণ সকলেই ঈর্ষান্বিত ছিল । বিশেষত গৌরীকান্ত তাহার যে ছিল । কারণ, সম্পর্ক প্রভৃতি অনুসারে সে নিজেকে অম্বিকার সমান জ্ঞান করিত এবং অম্বিকা তাহার আত্মীয় হইয়াও কেবলমাত্র ঈর্ষাবশতই তাহাকে উচ্চপদ দিতেছে না, এ ধারণা তাহার দৃঢ় ছিল । পদ পাইলেই পদের উপযুক্ত যোগ্যতা আপনি জোগায় এই তাহার মত । বিশেষত ম্যানেজারের কাজকে সে অত্যন্ত তুচ্ছ জ্ঞান করিত ; বলিত, সেকালে রথের উপর যেমন ধ্বজ থাকিত, আজকাল আপিসের কাজে ম্যানেজার সেইরূপ- ঘোড়া-বেটা খাটিয়া মরে আর ধবজা-মহাশয় রথের সঙ্গে সঙ্গে কেবল দপভরে দুলিতে থাকেন । বিনোদ ইতিপূর্বে কাজকর্মের কোনো খোঁজখবর লইত না ; কেবল যখন ব্যাবসা উপলক্ষে হঠাৎ অনেক টাকার প্রয়োজন হইত। তখন গোপনে খাজাঞ্চিকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিত, এখন তহবিলে কত টাকা আছে ? খাজাঞ্চি টাকার পরিমাণ বলিলে কিঞ্চিৎ ইতস্তত করিয়া সে টাকাটা চাহিয়া ফেলিত, যেন তাহা পরের টাকা । খাজাঞ্চি তাহার নিকট সই লইয়া টাকা দিত, তাহার পরে কিছুকাল ধরিয়া অম্বিকাবাবুর নিকট বিনোদ কুষ্ঠিত হইয়া থাকিত । কোনোমতে তাহার সহিত সাক্ষাৎ না হইলেই আরাম বোধ করিত । অম্বিকাচরণ মাঝে মাঝে ইহা লইয়া বিপদে পড়িতেন । কারণ, জমিদারের অংশ জমিদারকে দিয়া তহবিলে প্ৰায় আমানতি সদরখাজনা, অথবা আমলাবর্গের বেতন প্রভৃতি খরচের টাকা জমা থাকিত । সে টাকা অন্যায় ব্যয় হইয়া গেলে বড়োই অসুবিধা ভোগ করিতে হইত। কিন্তু বিনােদ টাকাটি লইয়া এমনি চোরের মতো লুকাইয়া বেড়াইত যে, তাহাকে এ সম্বন্ধে কোনো কথা বলিবার অবসর পাওয়া যাইত না ; পত্ৰ লিখিলেও কোনো ফল হইত না ; কারণ, লোকটার কেবল চক্ষুলজা ছিল, আর-কোনো লজ্জা ছিল না, এইজন্য সে কেবল সাক্ষাৎকারকে ডরাইত। -