পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৬৪ রবীন্দ্র-রচনাবলী করিয়াছিল । একটার পর একটা ব্যাবসা ফাদিয়া সে যতই প্ৰতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছিল ততই তাহার রোখি চড়িয়া যাইতেছিল ; ততই নূতন নুতন অসম্ভব উপায়ে আপন ক্ষতি নিবারণের চেষ্টা করিয়া অবশেষে আকণ্ঠ ঋণে নিমগ্ন হইয়াছে। অম্বিকাচরণ যখন পীড়িত ছিলেন তখন বিনোদ সেই সুযোগে তহবিল হইতে সমস্ত টাকা উঠাইয়া লইয়াছে। বাকাগাড়ি পরগনা অনেক কাল হইতেই পার্শ্ববতী জমিদারের নিকট রেহেনে আবদ্ধ ; সে এ-পর্যন্ত টাকার জন্য কোনোপ্রকার তাগাদা না দিয়া অনেক টাকা সুদ জমিতে দিয়াছে, এখন সময় বুঝিয়া হঠাৎ ডিক্রি করিয়া লইতে উদ্যত হইয়াছে। এই তো বিপদ । শুনিয়া অম্বিকাচরণ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন । অবশেষে কহিলেন, “আজ কিছুই ভেবে উঠতে পারছি নে, কাল এর পরামর্শ করা যাবে ।” খাজাঞ্চি যখন বিদায়- লইতে উঠিলেন তখন অম্বিকা তাহার ইস্তফাপত্ৰ চাহিয়া লইলেন । অন্তঃপুরে আসিয়া অম্বিকা ইন্দ্ৰাণীকে সকল কথা বিস্তারিত জানাইয়া কহিলেন, “বিনোদের এ অবস্থায় তো আমি কাজ ছেড়ে দিতে পারি। নে ৷” ইন্দ্ৰাণী অনেকক্ষণ প্রস্তরমূর্তির মতো স্থির হইয়া রহিল । অবশেষে অন্তরের সমস্ত বিরোধদ্বন্দ্ব সবলে দলন করিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “না, এখন ছাড়তে পার না ।” তাহার পরে “কোথায় টাকা” “কোথায় টাকা” করিয়া সন্ধান পড়িয়া গেলা- যথেষ্ট পরিমাণে টাকা আর জুটে না । অন্তঃপুর হইতে গহনাগুলি সংগ্ৰহ করিবার জন্য অম্বিকা বিনােদকে পরামর্শ দিলেন । ইতিপূর্বে ব্যাবসা উপলক্ষে বিনোদ সে চেষ্টা করিয়াছিলেন, কখনো কৃতকার্য হইতে পারেন নাই । এবারে অনেক অনুনয় বিনয় করিয়া, অনেক কাদিয়া-কাটিয়া, অনেক দীনতা স্বীকার করিয়া গহনাগুলি ভিক্ষা চাহিলেন । নিয়নতারা কিছুতেই দিলেন না ; তিনি মনে করিলেন, তাহার চারি দিক হইতে সকলই খসিয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছে ; এখন এই গহনাগুলি তাহার একমাত্র শেষ অবলম্বনস্থল— এবং ইহা তিনি অন্তিম আগ্রহ সহকারে প্রাণপণে চাপিয়া ধরিলেন । যখন কোথা হইতেও কোনো টাকা পাওয়া গেল না। তখন ইন্দ্রাণীর প্রতিহিংসাত্ৰুকুটির উপরে একটা তীব্ৰ আনন্দের জ্যোতি পতিত হইল । সে তাহার স্বামীর হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “তোমার যাহা কর্তব্য তাহা তো করিয়াছ ; এখন তুমি ক্ষান্ত হও, যাহা হইবার তা হউক ৷” স্বামীর অবমাননায় উদ্দীপ্ত সতীর রোষানল এখনো নির্বাপিত হয় নাই দেখিয়া অম্বিকা মনে মনে হাসিলেন । বিপদের দিনে অসহায় বালকের ন্যায় বিনোদ তাহার উপরে এমন একান্ত নির্ভর করিয়াছে যে, তাহার প্রতি র্তাহার। দয়ার উদ্রেক হইয়াছে- এখন তাহাকে তিনি কিছুতেই ত্যাগ করিতে পারেন। না । তিনি মনে করিতেছিলেন, তাহার নিজের বিষয় আবদ্ধ রাখিয়া টাকা উঠাইবার চেষ্টা করিবেন । কিন্তু ইন্দ্ৰাণী তাহাকে মাথার দিব্য দিয়া বলিল, “ইহাতে আর তুমি হাত দিতে পরিবে না ।” অম্বিকাচরণ বড়ো ইতস্ততের মধ্যে পডিয়া ভাবিতে বসিয়া গেলেন । তিনি ইন্দ্ৰাণীকে আস্তে আস্তে বুঝাইবার যতই চেষ্টা করিতে লাগিলেন ইন্দ্ৰাণী কিছুতেই তাহাকে কথা কহিতে দিল না । অবশেষে অম্বিকা কিছু বিমর্ষ হইয়া, গভীর হইয়া, নিঃশব্দে বসিয়া রহিলেন । । তখন ইন্দ্ৰাণী লোহার সিন্দুক খুলিয়া তাহার সমস্ত গহনা একটি বৃহৎ থালায় স্তৃপকার করিল এবং সেই গুরুভার থালাটি বহুকষ্টে দুই হস্তে তুলিয়া ঈষৎ হাসিয়া তাহার স্বামীর পায়ের কাছে রাখিল । পিতামহের একমাত্র স্নেহের ধন ইন্দ্ৰাণী পিতামহের নিকট হইতে জন্মাবধি বৎসরে বৎসরে অনেক বহুমূল্য অলংকার উপহার পাইয়া আসিয়াছে ; মিতাচারী স্বামীরও জীবনের অধিকাংশ সঞ্চয় এই সন্তানহীন রমণীর ভাণ্ডারে অলংকাররাপে রূপান্তরিত হইয়াছে । সেই সমস্ত স্বর্ণমাণিক্য স্বামীর নিকট উপস্থিত করিয়া ইন্দ্ৰাণী কহিল, “আমার এই গহনাগুলি দিয়া আমার পিতামহের দত্ত দান উদ্ধার করিয়া আমি পুনর্বাের তাহার প্রভুবংশকে দান করিব ?” এই বলিয়া সে সজল চক্ষু মুদ্রিত করিয়া মন্তক নত করিয়া কল্পনা করিল, তাহার সেই বিরল শুভ্ৰকেশধারী, সরলাসুন্দরমুখচ্ছবি, শান্তস্নেহহাস্যময়, ধীপ্ৰদীপ্ত উজ্জ্বলগীেরকান্তি বৃদ্ধ পিতামহ এই