পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ৩৬৭ কলহাস্যের সহিত পরস্পরের দ্রুত অনুধাবন করিয়া আমার পাৰ্থ দিয়া স্নানাথিনীরা চলিয়া গেল । আমাকে যেন লক্ষ্য করিল না । তাহারা যেমন আমার নিকট অদৃশ্য, আমিও যেন সেইরূপ তাহাদের নিকট অদৃশ্য । নদী পূর্ববৎ স্থির ছিল, কিন্তু আমার নিকট স্পষ্ট বোধ হইল, স্বচ্ছতোয়ার অগভীর স্রোত অনেকগুলি বলয়শিঞ্জিত বাহুবিক্ষেপে বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে ; হাসিয়া হাসিয়া সখীগণ পরস্পরের গায়ে জল ষ্টুড়িয়া মারিতেছে, এবং সস্তরণকারিণীদের পদাঘাতে জলবিন্দুরাশি মুক্তামুষ্টির মতো আকাশে ছিটিয়া পড়িতেছে । আমার বক্ষের মধ্যে একপ্রকার কম্পন হইতে লাগিল ; সে উত্তেজনা ভয়ের কি আনন্দের কি কৌতুহলের, ঠিক বলিতে পারি না । বড়ো ইচ্ছা হইতে লাগিল ভালো করিয়া দেখি, কিন্তু সম্মুখে দেখিবার কিছু ছিল না ; মনে হইল ভালো করিয়া কান পাতিলেই উহাদের কথা সমস্তই স্পষ্ট শোনা যাইবে, কিন্তু একান্তমনে কান পাতিয়া কেবল অরণ্যের ঝিল্লিরব শোনা যায়। মনে হইল, আড়াই শত বৎসরের কৃষ্ণবৰ্ণ যবনিকা ঠিক আমার সম্মুখে দুলিতেছে— ভয়ে ভয়ে একটি ধার তুলিয়া ভিতরে দৃষ্টিপাত করি— সেখানে বৃহৎ সভা বসিয়াছে, কিন্তু গাঢ় অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না । হঠাৎ শুমািট ভাঙিয়া হু হু করিয়া একটা বাতাস দিল- শুস্তার স্থির জলতলে দেখিতে দেখিতে একসঙ্গে মৰ্মরধ্বনি করিয়া যেন দুঃস্বল্প হইতে জাগিয়া উঠিল । স্বল্পই বল আর সত্যই বল, আড়াই শত বৎসরের অতীত ক্ষেত্ৰ হইতে প্রতিফলিত হইয়া আমার সম্মুখে যে এক অদৃশ্য মরীচিকা অবতীর্ণ হইয়াছিল তাহা চকিতের মধ্যে অন্তহিঁত হইল । যে মায়াময়ীরা আমার গায়ের উপর দিয়া দেহহীন দ্রুতপদে শব্দহীন উচ্চকলহাস্যে ছুটিয়া শুস্তার জলের উপর গিয়া ঝাপ দিয়া পড়িয়ছিল তাহারা সিক্ত অঞ্চল হইতে জল নিষ্কৰ্ষণ করিতে করিতে আমার পাশ দিয়া উঠিয়া গেল না । বাতাসে যেমন করিয়া গন্ধ উড়াইয়া লইয়া যায়, বসম্ভের এক নিশ্বাসে তাহারা তেমনি করিয়া” উড়িয়া চলিয়া গেল । তখন আমার বড়ো আশঙ্কা হইল যে, হঠাৎ বুঝি নির্জন পাইয়া কবিতাদেবী আমার স্কন্ধে আসিয়া ভর করিলেন ; আমি বেচারা তুলার মাশুল আদায় করিয়া খাটিয়া খাই, সর্বনাশিনী এইবার বুঝি আমার মুণ্ডপাত করিতে আসিলেন । ভাবিলাম, ভালো করিয়া আহার করিতে হইবে ; শূন্য উদরেই সকল প্রকার দুরারোগ্য রোগ আসিয়া চাপিয়া ধরে । আমার পাচাকটিকে ডাকিয়া প্রচুর ঘূতপক মসলা—সুগন্ধি রীতিমত মোগলাই খানা। হুকুম করিলাম । পরদিন প্ৰাতঃকালে সমস্ত ব্যাপারটি পরম হাস্যজনক বলিয়া বোধ হইল । আনন্দমনে সাহেবের মতো সোলাটুপি পরিয়া, নিজের হাতে গাড়ি হাকাইয়া, গড় গড় শব্দে আপিন তদন্তকার্যে চলিয়া গেলাম ! সেদিন ত্রৈমাসিক রিপোর্ট লিখিবার দিন থাকাতে বিলম্বে বাড়ি ফিরিবার কথা । কিন্তু সন্ধ্যা হইতে না হইতেই আমাকে বাড়ির দিকে টানিতে লাগিল । কে টানিতে লাগিল বলিতে পারি না ; কিন্তু মনে হইল, আর বিলম্ব করা উচিত হয় না । মনে হইল, সকলে বসিয়া আছে। রিপোর্ট অসমাপ্ত রাখিয়া সোলার টুপি মাথায় দিয়া সেই সন্ধ্যাধুসর তরুচ্ছায়াঘন নির্জন পথ রথচক্রশব্দে সচকিত করিয়া সেই অন্ধকার শৈলান্তবতী নিস্তব্ধ প্ৰকাণ্ড প্রাসাদে গিয়া উত্তীৰ্ণ হইলাম । সিঁড়ির উপরে সম্মুখের ঘরটি অতি বৃহৎ । তিন সারি বড়ো বড়ো থামের উপর কারুকাৰ্যখচিত খিলানে বিত্তীর্ণ ছাদ ধরিয়া রাখিয়াছে। এই প্ৰকাণ্ড ঘরটি আপনার বিপুল শূন্যতাভরে অহনিশি গম গম করিতে থাকে । সেদিন সন্ধ্যার প্রাকালে তখনো প্ৰদীপ জ্বালানো হয় নাই । দরজা ঠেলিয়া আমি সেই বৃহৎ ঘরে যেমন প্ৰবেশ করিলাম অমনি মনে হইল ঘরের মধ্যে যেন ভারি একটা বিপ্লব বাধিয়া গেলযেন হঠাৎ সভা ভঙ্গ করিয়া চারি দিকের দরজা জানলা ঘর পথ বরান্দা দিয়া কে কোন দিকে পলাইল তাহার ঠিকানা নাই। আমি কোথাও কিছু না দেখিতে পাইয়া অবাক হইয়া দাড়াইয়া রহিলাম। শরীর একপ্রকার আবেশে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল । যেন বহুদিবসের লুপ্তািবশিষ্ট মাথা ঘষা ও আতরের মৃদু। গন্ধ আমার নাসার মধ্যে প্ৰবেশ করিতে লাগিল । আমি সেই দীপহীন জনহীন প্ৰকাণ্ড ঘরের প্রাচীন প্রভােরস্তম্ভশ্রেণীর মাঝখানে দাড়াইয়া শুনিতে পাইলাম- কাির্কর শব্দে ফোয়ারার জল সাদা পাথরের