পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

*ENew VOAS হইতে ছিন্ন করিয়া, বিদ্যুৎগামী অশ্বের উপরে চড়াইয়া, জ্বলন্ত বালুকারাশি পার হইয়া, কোন রাজপুরীর দাসীহাটে বিক্রয়ের জন্য লইয়া গিয়াছিল । সেখানে কোন বাদশাহের ভূত্য তোমার নববিকশিত শিবিকায় বসাইয়া, প্ৰভূগৃহের অন্তঃপুরে উপহার দিয়াছিল। সেখানে সে কী ইতিহাস। সেই সারজীর সংগীত, নূপুরের নিক্কণ এবং সিরাজের সুবর্ণমন্দিরার মধ্যে মধ্যে ছুরির ঝালক, বিষের জ্বালা, কটাক্ষের আঘাত । কী অসীম ঐশ্বৰ্য, কী অনন্ত কারাগার । দুই দিকে দুই দাসী বলয়ের হীরকে বিজুলি খেলাইয়া চামর দুলাইতেছে । শাহেনশা বাদশা শুভ্র চরণের তলে মণিমুক্তাখচিত পাদুকার কাছে লুটাইতেছে ; দাড়াইয়া । তাহার পরে সেই রক্তকালুবিত ঈৰ্যাফেনিল ষড়যন্ত্রসংকুল ভীষণে জল ঐশ্বর্যপ্রবাহে ভাসমান হইয়া, তুমি মরুভূমির পুস্পমঞ্জরী কোন নিষ্ঠুর মৃত্যুর মধ্যে অবতীর্ণ অথবা কোন নিষ্ঠুরতর মহিমাতটে উৎক্ষিপ্ত হইয়াছিলে ? এমন সময় হঠাৎ সেই পাগলা মেহের আলি চীৎকার করিয়া উঠিল, “তফাত যাও, তফাত যাও । সব কুট হ্যায়, সব কুট হ্যায়।” চাহিয়া দেখিলাম, সকাল হইয়াছে ; চাপরাশি ডাকের চিঠিপত্ৰ লইয়া করিতে হইবে । আমি কহিলাম, না, আর এ বাড়িতে থাকা হয় না । সেইদিনই আমার জিনিসপত্র তুলিয়, আপিস-ঘরে গিয়া উঠিলাম । আপিসের বৃদ্ধ কেরানি করিম খা আমাকে দেখিয়া ঈষৎ হাসিল । আমি তাহার হাসিতে বিরক্ত হইয়া কোনো উত্তর না করিয়া কাজ করিতে লাগিলাম । যত বিকাল হইয়া আসিতে লাগিল ততই অন্যমনস্ক হইতে লাগিলাম--মনে হইতে লাগিল, এখনই কোথায় যাইবার আছে- তুলার হিসাব পরীক্ষার কাজটা নিতান্ত অনাবশ্যক মনে হইল, নিজামের নিজামতও আমার কাছে বেশি কিছু বোধ হইল না- যাহা-কিছু বর্তমান, যাহা-কিছু আমার চারি দিকে চলিতেছে ফিরিতেছে খাটিতেছে খাইতেছে। সমস্তই আমার কাছে অত্যন্ত দীন অর্থহীন অকিঞ্চিৎকর বলিয়া বোধ হইল । আমি কলম ছড়িয়া ফেলিয়া, বৃহৎ খাতা বন্ধ করিয়া তৎক্ষণাৎ টমটম চড়িয়া ছুটিলাম । দেখিলাম টমটম ঠিক গোধূলিমুহুর্তে আপনিই সেই পাষাণ-প্রাসাদের দ্বারের কাছে গিয়া থামিল । দ্রুত পদে সিঁড়িগুলি উত্তীর্ণ হইয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। " আজ সমস্ত নিস্তব্ধ । অন্ধকার ঘরগুলি যেন রাগ করিয়া মুখ ভার করিয়া আছে। অনুতাপে আমার পাইলাম না। আমি শূন্য মনে অন্ধকার ঘরে ঘরে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। ইচ্ছা করিতে লাগিল একখানা যন্ত্র হতে লইয়া কাহাকেও উদ্দেশ করিয়া গান গাহি ; বলি, “হে বহ্নি, যে পতঙ্গ তোমাকে ফেলিয়া পলাইবার চেষ্টা করিয়াছিল, সে আবার মরিবার জন্য আসিয়াছে। এবার তাহাকে মার্জন৷ করো, তাহার দুই পক্ষ দন্ধ করিয়া দাও, তাহাকে ভস্মসাৎ করিয়া ফেলো ।” হঠাৎ উপর হইতে আমার কপালে দুই ফোটা অশ্রািজল পড়িল । সেদিন আরালী পর্বতের চূড়ায় ঘনঘোর মেঘ করিয়া আসিয়াছিল । অন্ধকার অরণ্য এবং শুভার মসীবৰ্ণ জল একটি ভীষণ প্ৰতীক্ষায় স্থির হইয়া ছিল । জলস্থল আকাশ সহসা শিহরিয়া উঠিল ; এবং অকস্মাৎ একটা বিদ্যুজন্তবিকশিত ঝড় শঙ্খলিছিন্ন উন্মাদের মতো পথহীন সুদূর বনের ভিতর দিয়া আর্ত চীৎকার করিতে করিতে ছুটিয়া আসিল । প্রাসাদের বড়ো বড়ো শূন্য ঘরগুলা সমন্ত স্বার আছড়াইয়া তীব্ৰ বেদনায় হু হু করিয়া কঁাদিতে वनाव्ताि । আজ ভূত্যগণ সকলেই আপিস-ঘরে ছিল, এখানে আলো জ্বালাইবার কেহ ছিল না । সেই মেঘাচ্ছন্ন অমাবস্যার রাত্রে গৃহের ভিতরকার নিকবকৃষ্ণ অন্ধকারের মধ্যে আমি স্পষ্ট অনুভব করিতে