পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ . ܗܢܘ9ܘ অতিথি প্ৰথম পরিচ্ছেদ কাঠালিয়ার জমিদার মতিলালবাবু নৌকা করিয়া সপরিবারে স্বদেশে যাইতেছিলেন । পথের মধ্যে মধ্যাহ্নে নদীতীরের এক গঞ্জের নিকট নৌকা বাধিয়া পাকের আয়োজন করিতেছেন এমন সময় এক ব্ৰাহ্মণবালক আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বাবু, তোমরা যােচ্ছ কোথায় ?” প্ৰশ্নকর্তার বয়স পনেরো-ষোলোর অধিক হইবে না । মাতিবাবু উত্তর করিলেন, “কাঠালে।” ব্ৰাহ্মণবালক কহিল, “আমাকে পথের মধ্যে নদীৰ্গায়ে নাবিয়ে দিতে পাের ?” বাবু সম্মতি প্ৰকাশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কী ।” ব্ৰাহ্মণবালক কহিল, “আমার নাম তারাপদ ।” গৌরবর্ণ ছেলেটিকে বড়ো সুন্দর দেখিতে । বড়ো বড়ো চক্ষু এবং হাস্যময় ওষ্ঠা ধরে একটি সুললিত সৌকুমাৰ্য প্রকাশ পাইতেছে। পরিধানে একখানি মলিন ধুতি । অনাবৃত দেহখানি সর্বপ্রকার বাহুল্যবর্জিত ; কোনো শিল্পী যেন বহু যত্নে নিখুঁত নিটােল করিয়া গড়িয়া দিয়াছেন । যেন সে পূর্বজন্মে তাপসবালক ছিল এবং নির্মল তপস্যার প্রভাবে তাহার শরীর হইতে শরীরাংশ বহুলপরিমাণে ক্ষয় হইয়া একটি সম্মার্জিত ব্ৰাহ্মণ্যশ্ৰী পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। হবে ।” তারাপদ বলিল, “রোসুন ।” বলিয়া তৎক্ষণাৎ অসংকোচে রন্ধনের আয়োজনে যোগদান করিল। মতিলালবাবুর চাকরিটা ছিল হিন্দুস্থানী, মাছ কোটা প্ৰভৃতি কার্যে তাহার তেমন পটুতা ছিল না ; তারাপদ তাহার কাজ নিজে লইয়া অল্পকালের মধ্যেই সুসম্পন্ন করিল এবং দুই-একটা তরকারিও অভ্যস্ত নৈপুণ্যের সহিত রন্ধন করিয়া দিল। পাককার্য শেষ হইলে তারাপদ নদীতে স্নান করিয়া র্বোচক খুলিয়া একটি শুভ্ৰ বস্ত্র পরিল ; একটি ছোট কাঠের কাকই সইয়া মাথার বড়ো বড়ো চুল কপাল হইতে তুলিয়া গ্ৰীবার উপর ফেলিল এবং মার্জিত পইতার গোচ্ছা বক্ষে বিলম্বিত করিয়া নীেকায় মাতিবাবুর নিকট গিয়া উপস্থিত হইল । মাতিবাবু তাহাকে নীেকার ভিতরে লইয়া গেলেন । সেখানে মতিবাবুর স্ত্রী এবং তাহার নবমবধীয়া এক কন্যা বসিয়াছিলেন । মতিবাবুর স্ত্রী অন্নপূর্ণ এই সুন্দর বালকটিকে দেখিয়া স্নেহে উচ্ছসিত হইয়া উঠিলেন— মনে মনে কহিলেন, আহা, কাহার বাছা, কোথা হইতে আসিয়াছে — ইহার মা ইহাকে ছাড়িয়া কেমন করিয়া প্ৰাণ ধরিয়া আছে । যথাসময়ে মতিবাবু এবং এই ছেলেটির জন্য পাশাপাশি দুইখানি আসন পড়িল । ছেলেটি তেমন ভোজনপটু নহে ; অন্নপূর্ণ তাহার স্বল্প আহার দেখিয়া মনে করিলেন, সে লজা করিতেছে ; তাহাকে এটা ওটা খাইতে বিস্তর অনুরোধ করিলেন ; কিন্তু যখন সে আহার হইতে নিরস্ত হইল তখন সে কোনো অনুরোধ মানিল না। দেখা গেল, ছেলেটি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছা-অনুসারে কাজ করে, অথচ এমন সহজে করে যে তাহাতে কোনোপ্রকার জেদ বা গো প্ৰকাশ পায় না। তাহার ব্যবহারে লজ্জার লক্ষণও লেশমাত্র দেখা গেল না । সকলের আহারাদির পরে অন্নপূর্ণ তাহাকে কাছে বসাইয়া প্রশ্ন করিয়া তাহার ইতিহাস জানিতে প্রবৃত্ত হইলেন । বিস্তারিত বিবরণ কিছুই সংগ্ৰহ হইল না । মোট কথা এইটুকু জানা গেল, ছেলেটি সাত-আট বৎসর বয়সেই স্বেচ্ছাক্রমে ঘর ছাড়িয়া পলাইয়া আসিয়াছে। r অন্নপূর্ণ প্রশ্ন করিলেন, “তোমার মা নাই ?” তারাপদ কহিল, “আছেন।” ।