পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Վ)Գ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী অন্নপূর্ণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “তিনি তোমাকে ভালোবাসেন না ?” তারাপদ এই প্রশ্ন অত্যন্ত অদ্ভুত জ্ঞান করিয়া হাসিয়া উঠিয়া কহিল, “কেন ভালোবাসবেন না ?” অন্নপূর্ণ প্রশ্ন করিলেন, “তবে তুমি তাকে ছেড়ে এলে যে ?” তারাপদ কহিল, “তার আরো চারটি ছেলে এবং তিনটি মেয়ে আছে ।” অন্নপূর্ণ বালকের এই অদ্ভুত উত্তরে ব্যথিত হইয়া কহিলেন, “ওমা, সে কী কথা ! পাঁচটি আঙুল আছে বলে কি একটি আঙুল ত্যাগ করা যায় ।” তারাপদর বয়স অল্প, তাহার ইতিহাসও সেই পরিমাণে সংক্ষিপ্ত, কিন্তু ছেলেটি সম্পূৰ্ণ নূতনতর। সে তাহার পিতামাতার চতুর্থ পুত্র, শৈশবেই পিতৃহীন হয় ; বহু সম্ভানের ঘরেও তারাপদ সকলের অত্যন্ত আদরের ছিল ; মা ভাই বোন এবং পাড়ার সকলেরই নিকট হইতে সে অজস্র স্নেহ লাভ করিত । এমন-কি, শুরুমহাশয়ও তাঁহাকে মারিত না ; মারিলেও বালকের আত্মীয় পর সকলেই তাহাতে বেদনা বোধ করিত । এমন অবস্থায় তাহার গৃহত্যাগ করিবার কোনোই কারণ ছিল না । যে উপেক্ষিত রোগা ছেলেটা সর্বদাই চুরি-করা গাছের ফল এবং গৃহস্থ লোকদের নিকট তাহার চতুৰ্ত্তণ প্রতিফল খাইয়া বেড়ায় সেও তাহার পরিচিত গ্রামসীমার মধ্যে তাহার নির্যাতনকারিণী মার নিকট পড়িয়া রহিল, ছাড়িয়া পলায়ন করিল। সকলে খোজ করিয়া তাহকে গ্রামে ফিরাইয়া আনিল । তাহার মা তাহাকে বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া বিস্তর প্রশ্রয় এবং পুরস্কার দিল । পাড়ার মেয়েরা তাহাকে ঘরে ঘরে ডাকিয়া প্রচুরতর আদর এবং বহুতর প্রলোভনে বাধ্য করিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু বন্ধন, এমন-কি, স্নেহবন্ধনও তােহর সহিল না ; তাহার জন্মনক্ষত্র তাহাকে গৃহহীন করিয়া দিয়াছে ; সে যখনই দেখিত নদী দিয়া বিদেশী নীেকা গুণ টানিয়া চলিয়াছে, গ্রামের বৃহৎ অশ্বথগাছের তলে কোন দূরদেশ হইতে এক সন্ন্যাসী আসিয়া আশ্রয় লইয়াছে, অথবা বেদেরা নদীতীরের পতিত মাঠে ছোটো ছোটো চাটাই বাধিয়া ব্যাখ্যারি ছুলিয়া চাঙারি নির্মাণ করিতে বসিয়াছে, তখন অজ্ঞাত বহিঃপৃথিবীর স্নেহহীন স্বাধীনতার জন্য তাহার চিত্ত অশান্ত হইয়া উঠিত । উপরি-উপরি দুই-তিনবার পলায়নের পর তাহার আত্মীয়বর্গ এবং গ্রামের লোক তাহার আশা পরিত্যাগ করিলা । প্রথম সে একটা যাত্রার দলের সঙ্গ লইয়াছিল । অধিকারী যখন তাহাকে পুত্ৰনির্বিশেষে স্নেহ করিতে লাগিল এবং দলস্থ ছোটো-বড়ো সকলেরই যখন সে প্ৰিয়পাত্র হইয়া উঠিল, এমন-কি, যে বাড়িতে যাত্রা হইত। সে বাড়ির অধ্যক্ষগণ, বিশেষত পুরমহিলাবৰ্গ, যখন বিশেষরূপে তাহাকে আহবান করিয়া সমাদর করিতে লাগিল, তখন একদিন সে কাহাকেও কিছু না বলিয়া কোথায় নিরুদ্দেশ হইয়া গেল। তাহার। আর সন্ধান পাওয়া গেল না । তারাপদ হরিণশিশুর মতো বন্ধনভীরু, আবার হরিণেরই মতো সংগীতমুগ্ধ । যাত্রার গানেই তাহাকে প্ৰথম ঘর হইতে বিবাগি করিয়া দেয় । গানের সুরে তাহার সমস্ত শিরার মধ্যে অনুকম্পন এবং গানের তালে তাহার সর্বাঙ্গে আন্দোলন উপস্থিত হইত। যখন সে নিতান্ত শিশু ছিল তখনো সংগীতসভায় সে সম্বরণ করা দুঃসাধ্য হইত। কেবল সংগীত কেন, গাছের ঘন পল্লবের উপর যখন শ্রাবণের বৃষ্টিধারা পড়িত, আকাশে মেঘ ডাকিত, অরণ্যের ভিতর মাতৃহীন দৈত্যশিশুর ন্যায় বাতাস ক্ৰন্দন করিতে থাকিত, তখন তাহার চিত্ত যেন উজ্জ্বৰখল হইয়া উঠিত । নিস্তািন্ধ দ্বিপ্রহরে বহুদূর আকাশ হইতে চিলের ডাক, বর্ষার সন্ধ্যায় ভেকের কলরব, গভীর রাত্ৰে শৃগালের চীৎকার ধবনি সকলই তাহাকে উতলা করিত । এই সংগীতের মোহে আকৃষ্ট হইয়া সে অনতিবিলম্বে এক পাচলির দলের মধ্যে গিয়া প্রবিষ্ট হইল । দঝাধ্যক্ষ তাহাকে পরম যত্নে গান শিখাইতে এবং পাচালি মুখস্থ করাইতে প্ৰবৃত্ত হইল, এবং