পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী و ۹ O\ সুদূরতা, এই সুবৃহৎ চিরস্থায়ী নির্নিমেষ বাক্যবিহীন বিশ্বজগৎ তরুণ বালকের পরমাত্মীয় ছিল ; অথচ সে এই চঞ্চল মানবকটিকে এক মুহুর্তের জন্যও স্নেহবাহুদ্বারা ধরিয়া রাখিতে ‘চেষ্টা করিত না । নদীতীরে বাছুর লেজ তুলিয়া ছুটিতেছে, গ্ৰাম্য টাটুঘোড়া সম্মুখের দুই দড়ি-বাধা পা লইয়া লাফ দিয়া দিয়া ঘাস খাইয়া বেড়াইতেছে, মাছরাঙা জেলেদের জাল বাধিবার বংশদণ্ডের উপর হইতে ঝাপ করিয়া সবেগে জলের মধ্যে বঁপাইয়া মাছ ধরিতেছে, ছেলেরা জলের মধ্যে পড়িয়া মাতামাতি করিতেছে, মেয়েরা উচ্চকণ্ঠে সহাস্য গল্প করিতে করিতে আবক্ষজলে বসনাঞ্চল প্রসারিত করিয়া দুই হস্তে তাহা মার্জন করিয়া লইতেছে, কোমরবাধা মেছুনিরা চুপড়ি লইয়া জেলেদের নিকট হইতে মাছ কিনিতেছে, এ-সমস্তই সে চিরনূতন অশ্রান্ত কৌতুহলের সহিত বসিয়া বসিয়া দেখে, কিছুতেই তাহার দৃষ্টির পিপাসা न्तृिद्ध श्श न्ा । নীেকার ছাতের উপরে গিয়া তারাপদ ক্রমশ দাড়িমাঝিদের সঙ্গে গল্প জুড়িয়া দিল । মাঝে মাঝে আবশ্যকমতে মাল্লাদের হাত হইতে লাগি লইয়া নিজেই ঠেলিতে প্ৰবৃত্ত হইল ; মাঝির যখন তামাক খাইবার আবশ্যক তখন সে নিজে গিয়া হাল ধরিল- যখন যে দিকে পাল ফিরানো আবশ্যক সমস্ত সে দক্ষতার সহিত সম্পন্ন করিয়া দিল । সন্ধ্যার প্রাককালে অন্নপূর্ণ তারাপদকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাত্ৰে তুমি কী খাও ?” তারাপদ কহিল, “যা পাই তাই খাই ; সকল দিন খাইও না ।” এই সুন্দর ব্ৰাহ্মণবালকটির আতিথ্যগ্রহণে ঔদাসীন্য অন্নপূর্ণাকে ঈষৎ পীড়া দিতে লাগিল । তাহার বড়ো ইচ্ছা, খাওয়াইয়া পরাইয়া এই গৃহচ্যুত পান্থ বালকটিকে পরিতৃপ্ত করিয়া দেন । কিন্তু কিসে যে তাহার পরিতোষ হইবে তাহার কোনো সন্ধান পাইলেন না। অন্নপূর্ণ চাকরদের ডাকিয়া গ্রাম হইতে দুধ মিষ্টান্ন প্রভৃতি ক্রয় করিয়া আনিবার জন্য ধুমধাম বাধাইয়া দিলেন । তারাপদ যথা পরিমাণে আহার করিল ; কিন্তু দুধ খাইল না । মৌনস্বভাব মতিলালবাবুও তাঁহাকে দুধ খাইবার জন্য অনুরোধ করিলেন ; সে সংক্ষেপে বলিল, “আমার ভালো লাগে না ।” নদীর উপর দুই-তিন দিন গেল । তারাপদ রাধাবাড়া, বাজার করা হইতে নীেকাচালনা পর্যন্ত সকল কাজেই স্বেচ্ছ এবং তৎপরতার সহিত যোগ দিল । যে-কোনো দৃশ্য তাহার চোখের সম্মুখে আসে তাহার প্রতি তারাপদর সকৌতুহল দৃষ্টি ধাবিত হয়, যে-কোনো কাজ তাহার হাতের কাছে আসিয়া উপস্থিত হয় তাহাতেই সে আপনি আকৃষ্ট হইয়া পড়ে। তাহার দৃষ্টি, তাহার হস্ত, তাহার মন সর্বদাই সচল হইয়া আছে ; এইজন্য সে এই নিত্যসচলা প্ৰকৃতির মতো সর্বদাই নিশ্চিন্ত উদাসীন, অথচ সর্বদাই ক্রিয়াসক্ত । মানুষমাত্রেরই নিজের একটি স্বতন্ত্র অধিষ্ঠানভূমি আছে ; কিন্তু তারাপদ এই অনন্ত নীলাম্বরবাহী বিশ্বপ্রবাহের একটি আনন্দোজল তরঙ্গ- ভূতভবিষ্যতের সহিত তাহার কোনো বন্ধন নাই- সম্মুখাভিমুখে চলিয়া যাওয়াই তাহার একমাত্র কার্য । এ দিকে অনেকদিন নানা সম্প্রদায়ের সহিত যোগ দিয়া অনেকপ্ৰকার মনোরঞ্জনী বিদ্যা তাহার আয়ত্ত হইয়াছিল। কোনোপ্রকার চিন্তার দ্বারা আচ্ছন্ন না থাকাতে তাহার নির্মল স্মৃতিপটে সকল জিনিস আশ্চর্য সহজে মুদ্রিত হইয়া যাইত। পাচালি কথকতা কীর্তনগান যাত্রাভিনয়ের সুদীর্ঘ খণ্ডসকল তাহার কণ্ঠাগ্রে ছিল। মতিলালবাবু চিরপ্রথামত একদিন সন্ধ্যাবেলায় তাহার স্ত্রীকন্যাকে রামায়ণ পড়িয়া শুনাইতেছিলেন ; কুশলবের কথার সূচনা হইতেছে এমন সময় তারাপদ উৎসাহ সম্বরণ করিতে না পারিয়া নীেকার ছাদের উপর হইতে নামিয়া আসিয়া কহিল, “বই রাখুন। আমি কুশলবের গান করি, আপনারা শুনে যান ।” এই বলিয়া সে কুশলবের পাচালি আরম্ভ করিয়া দিল । বাঁশির মতো সুমিষ্ট পরিপূর্ণস্বরে দাশুরায়ের অনুপ্রাস ক্ষিপ্ৰবেগে বর্ষণ করিয়া চলিল। দাড়ি মাঝি সকলেই দ্বারের কাছে আসিয়া কুঁকিয়া পড়িল ; হাস্য করুণা এবং সংগীতে সেই নদীতীরের সন্ধ্যাকাশে এক অপূর্ব রসস্রোত প্রবাহিত হইতে লাগিলদুই নিস্তব্ধ তটভূমি কুতুহলী হইয়া উঠিল, পাশ দিয়া যে-সকল নৌকা চলিতেছিল তাহাদের আরোহীগণ ক্ষণকালের জন্য উৎকষ্ঠিত হইয়া সেই দিকে কান দিয়া রহিল ; যখন শেষ হইয়া গেল