পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\obro রবীন্দ্র-রচনাবলী চারুও আজকাল তাহাকে বড়ো একটা দেখিতে পাইত না। পূর্বে তারাপদ অন্তঃপুরে গিয়া অন্নপূর্ণার স্নেহদৃষ্টির সম্মুখে বসিয়া আহার করিত- কিন্তু তদুপলক্ষে প্ৰায় মাঝে মাঝে কিছু বিলম্ব হইয়া যাইত বলিয়া সে মতিবাবুকে অনুরোধ করিয়া বাহিরে আহারের বন্দোবস্ত করিয়া লইল । ইহাতে অন্নপূর্ণ ব্যথিত হইয়া। আপত্তি প্ৰকাশ করিয়াছিলেন, কিন্তু মাতিবাবু বালকের অধ্যয়নের উৎসাহে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া এই নূতন ব্যবস্থার অনুমোদন করিলেন । এমন সময় চারুও হঠাৎ জেদ করিয়া বসিল, “আমিও ইংরাজি শিখিব ।” তাহার পিতামাতা র্তাহাদের খামখেয়ালি কন্যার এই প্রস্তাবটিকে প্রথমে পরিহাসের বিষয় জ্ঞান করিয়া স্নেহমিশ্রিত হাস্য করিলেন ; কিন্তু কন্যাটি এই প্ৰস্তাবের পরিহাস্য অংশটুকুকে - প্রচুর অশ্রুজলধারায় অতি শীঘ্রই নিঃশেষে ধৌত করিয়া ফেলিয়াছিল। অবশেষে এই মেহদুর্বল নিরুপায় অভিভাবকদ্বয় বালিকার প্ৰস্তাব গভীরভাবে গ্রাহ্য করিলেন । চারু মাস্টারের নিকট তারাপদর সহিত একত্র অধ্যয়নে নিযুক্ত হইল । কিন্তু পড়াশুনা করা এই অস্থিরচিত্ত বালিকার স্বভাবসংগত ছিল না । সে নিজে কিছু শিখিল না, কেবল তারাপদর অধ্যয়নে ব্যাঘাত করিতে লাগিল । সে পিছাইয়া পড়ে, পড়া মুখস্থ করে না, কিন্তু তবু কিছুতেই তারাপদর পশ্চাদবর্তী হইয়া থাকিতে চাহে না । তারাপদ তাহাকে অতিক্রম করিয়া নূতন পড়া লাইতে গেলে সে মহা রাগারগি করিত, এমন-কি, কান্নাকাটি করিতে ছাড়িত না । তারাপদ পুরাতন বই শেষ করিয়া নুতন বই কিনিলে তাহাকেও সেই নূতন বই কিনিয়া দিতে হইত। তারাপদ অবসরের সময় নিজে ঘরে বসিয়া লিখিত এবং পড়া মুখস্থ করিত, ইহা সেই ঈৰ্ষাপরায়ণা কন্যাটির সহ্য হইত না ; সে গোপনে তাহার লেখা খাতায় কালি ঢালিয়া আসিত, কলম চুরি করিয়া রাখিত, এমন-কি, বইয়ের যেখানে অভ্যাস করিবার, সেই অংশটি ছিড়িয়া আসিত । তারাপদ এই বালিকার অনেক দৌরাত্ম্য সকৌতুকে সহ্য করিত, অসহ্য হইলে মারিত, কিন্তু কিছুতেই শাসন করিতে পারিত না । দৈবাৎ একটা উপায় বাহির হইল। একদিন বড়ো বিরক্ত হইয়া নিরুপায় তারাপদ তাহার মসীবিলুপ্ত লেখা খাতা ছিন্ন করিয়া ফেলিয়া গভীর বিষয়মুখে বসিয়া ছিল ; চারু দ্বারের কাছে আসিয়া মনে করিল, আজ মাের খাইবে । কিন্তু তাহার প্রত্যাশা পূর্ণ হইল না। তারাপদ একটি কথামাত্র না কহিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বালিকা ঘরের ভিতরে বাহিরে ঘুরঘুর করিয়া বেড়াইতে লাগিল। বারংবার এত কাছে ধরা দিল যে, তারাপদ ইচ্ছা করিলে অনায়াসেই তাহার পৃষ্ঠে এক চপেটাঘাত বসাইয়া দিতে পারিত । কিন্তু সে তাহা না দিয়া গভীর হইয়া রহিল। বালিকা মহা মুশকিলে পড়িল । কেমন করিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিতে হয় সে বিদ্যা তাহার কোনোকালেই অভ্যাস ছিল না, অথচ অনুতপ্ত ক্ষুদ্র হৃদয়টি তাহার সহপাঠীর ক্ষমালাভের জন্য একান্ত কাতর হইয়া উঠিল । অবশেষে কোনো উপায় না দেখিয়া ছিন্ন খাতার এক টুকরা লইয়া তারাপদর নিকটে বসিয়া খুব বড়ো বড়ো করিয়া লিখিলে, “আমি আর কখনো খাতায় কালি মাখাব না।” লেখা শেষ করিয়া সেই লেখার প্রতি তারাপদর মনােযোগ আকর্ষণের জন্য অনেকপ্ৰকার চাঞ্চল্য প্ৰকাশ করিতে লাগিল । দেখিয়া তারাপদ হাস্য সম্বরণ করিতে পারিল নাহাসিয়া উঠিল । তখন বালিকা লজ্জায় ক্ৰোধে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিয়া ঘর হইতে দ্রুতবেগে ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। যে কাগজের টুকরায় সে স্বহস্তে দীনতা প্রকাশ করিয়াছে সেটা অনন্ত কাল এবং অনন্ত জগৎ হইতে সম্পূর্ণ লোপ করিতে পারিলে তবে তাহার হৃদয়ের নিদারুণ ক্ষোভ মিটিতে পারিত | এ দিকে সংকুচিত চিত্ত সোনামণি দুই-একদিন অধ্যয়নশালার বাহিরে উকিঝুকি মারিয়া ফিরিয়া চলিয়া গিয়াছে। সখী চারুশশীর সহিত তাহার সকল বিষয়েই বিশেষ হৃদ্যতা ছিল, কিন্তু তারাপদর সম্বন্ধে চারুকে সে অত্যন্ত ভয় এবং সন্দেহের সহিত দেখিত । চারু যে সময়ে অন্তঃপুরে থাকিত সেই সময়টি বাছিয়া সোনামণি সসংকোচে তারাপদর দ্বারের কাছে আসিয়া দাড়াইত । তারাপদ বই হইতে মুখ তুলিয়া সস্নেহে বলিত, “কী সোনা । খবর কী । মাসি কেমন আছে।” সোনামণি কাহিত, “অনেকদিন যাও নি, মা তোমাকে একবার যেতে বলেছে । মার কোমরে ব্যথা বলে দেখতে আসতে পারে না ।”