পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ Voro) আপনার ক্ষুদ্র ঘরকন্না লইয়া একাকিনী দিন-যাপন করিতে থাকে, বর্ষার সময় বাহিরের বৃহৎ পৃথিবী বিচিত্র পণ্যোপহার লইয়া গৈরিকবর্ণজলরথে চড়িয়া এই গ্ৰামকন্যকাগুলির তত্ত্ব লাইতে আসে ; তখন জগতের সঙ্গে আত্মীয়তাগর্বে কিছুদিনের জন্য তাহদের ক্ষুদ্রতা ঘুচিয়া যায়, সমস্তই সচল সজাগ সজীব হইয়া উঠে এবং মীেন নিস্তব্ধ দেশের মধ্যে সুদূর রাজ্যের কলালাপধ্বনি আসিয়া চারি দিকের আকাশকে আন্দোলিত করিয়া তুলে । এই সময়ে কুন্ডুলকাটায় নাগবাবুদের এলাকায় বিখ্যাত রথযাত্রার মেলা হইবে । জ্যোৎস্নাসন্ধ্যায় তারাপদ ঘাটে গিয়া দেখিল, কোনো নৌকা নাগরদোলা, কোনো নৌকা যাত্রার দল, কোনো নৌকা পণ্যদ্রব্য লইয়া প্ৰবল নবীন স্রোতের মুখে দ্রুতবেগে মেলা অভিমুখে চলিয়াছে ; কলিকাতার কনসার্টের দল বিপুলশব্দে দ্রুততালের বাজনা জুড়িয়া দিয়াছে ; যাত্রার দল বেহালার সঙ্গে গান গাহিতেছে এবং সমের কাছে হাহাহাঃ শব্দে চীৎকার উঠিতেছে ; পশ্চিমদেশী নৌকার দাড়িমাল্লাগুলো কেবলমাত্র মাদল এবং করতাল লইয়া উন্মত্ত উৎসাহে বিনা সংগীতে খচমচ শব্দে আকাশ বিদীর্ণ করিতেছে- উদ্দীপনার সীমা নাই। দেখিতে দেখিতে পূর্বদিগন্ত হইতে ঘনমেঘরাশি প্ৰকাণ্ড কালো পাল তুলিয়া দিয়া আকাশের মাঝখানে উঠিয়া পড়িল, চাদ। আচ্ছন্ন হইল- পুবে-বাতাস বেগে বহিতে লাগিল, মেঘের পশ্চাতে মেঘ ছুটিয়া চলিল, নদীর জল খল খল হাস্যে স্ফীত হইয়া উঠিতে লাগিল- নদীতীরবতী আন্দোলিত বনশ্রেণীর মধ্যে অন্ধকার পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিল, ভেক ডাকিতে আরম্ভ করিল, ঝিল্লিধ্বনি যেন করাত দিয়া অন্ধকারকে চিরিতে লাগিল । সম্মুখে আজ যেন সমস্ত জগতের রথযাত্রা- চাকা ঘুরিতেছে, ধ্বজা উড়িতেছে, পৃথিবী কঁাপিতেছে ; মেঘ উড়িয়াছে, বাতাস ছুটিয়াছে, নদী বহিয়াছে, নীেকা চলিয়াছে, গান উঠিয়াছে ; দেখিতে দেখিতে শুরু গুরু শব্দে মেঘ ডাকিয়া উঠিল, বিদ্যুৎ আকাশকে কাটিয়া কাটিয়া ঝলসিয়া উঠিল, সুদূর অন্ধকার হইতে একটা মুষলধারাবৰী বৃষ্টির গন্ধ আসিতে লাগিল । কেবল নদীর এক তীরে এক পার্থে কাঠালিয়া গ্রাম আপনি কুটির দ্বার বন্ধ করিয়া দীপ নিবাইয়া দিয়া নিঃশব্দে ঘুমাইতে লাগিল । পরদিন তারাপদর মাতা ও ভ্ৰাতাগণ র্কাঠালিয়ায় আসিয়া অবতরণ করিলেন, পরদিন কলিকাতা হইতে বিবিধসামগ্ৰীপূৰ্ণ তিনখানা বড়ো নীেকা আসিয়া কাঠালিয়ার জমিদারি কাছারির ঘাটে লাগিল, এবং পরদিন অতি প্ৰাতে সোনামণি কাগজে কিঞ্চিৎ আমসত্ত এবং পাতার ঠোঙায় কিঞ্চিৎ আচার গেল না। স্নেহ-প্ৰেম-বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্রবন্ধন তাহাকে চারি দিক হইতে সম্পূর্ণরূপে ঘিরিবার পূর্বেই সমস্ত গ্রামের হৃদয়খানি চুরি করিয়া একদা বর্ষার মেঘান্ধকার রাত্রে এই ব্ৰাহ্মণবালক আসক্তিবিহীন উদাসীন জননী বিশ্বপূথিবীর নিকট চলিয়া গিয়াছে। VSE-RiffRSR5 yeo ইচ্ছাপূরণ সুবলচন্দ্রের ছেলেটির নাম সুশীলচন্দ্র। কিন্তু সকল সময়ে নামের মতো মানুষটি হয় না। সেইজন্যই সুবলচন্দ্ৰ কিছু দুর্বল ছিলেন এবং সুশীলচন্দ্ৰ বড়ো শান্ত ছিলেন না । ছেলেটি পাড়াসুদ্ধ লোককে অস্থির করিয়া বেড়াইত, সেইজন্য বাপ মাঝে মাঝে শাসন করিতে ছুটিতেন ; কিন্তু বাপের পায়ে ছিল বাত, আর ছেলেটি হরিণের মতো দোঁড়িতে পারিত ; কাজেই কিল চড়-চাপড় সকল সময় ঠিক জায়গায় গিয়া পড়িত না । কিন্তু সুশীলচন্দ্ৰ দৈবাৎ যেদিন ধরা পড়িতেন সেদিন তাহার। আর রক্ষা থাকিত না ।