পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vors রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী মন উঠিতেছিল না । তাহার অনেকগুলা কারণ ছিল । একে তো আজ স্কুলে ভূগোলের পরীক্ষা, তাহাতে আবার ও পাড়ার বোসেন্দের বাড়ি আজ সন্ধ্যার সময় বাজি পোড়ানো হইবে । সকাল হইতে সেখানে ধুমধাম চলিতেছে। সুশীলের ইচ্ছা, সেইখানেই আজ দিনটা কাটাইয়া দেয় । অনেক ভাবিয়া, শেষকালে স্কুলে যাইবার সময় বিছানায় গিয়া শুইয়া পড়িল । তাহার বাপ সুবল গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী রে, বিছানায় পড়ে আছিস যে । আজ ইস্কুলে যাবি নে ?” সুশীল বলিল, “আমার পেট কামড়াচ্ছে, আজ আমি ইস্কুলে যেতে পারব না।” সুবল তাহার মিথ্যা কথা সমস্ত বুঝিতে পারিলেন । মনে মনে বলিলেন, ‘রোসো, একে আজ জব্দ” করতে হবে।” এই বলিয়া কহিলেন, “পেট কামড়াচ্ছে ? তবে আর তোর কোথাও গিয়ে কাজ নেই। বোসেন্দের বাড়ি বাজি দেখতে হরিকে একলাই পাঠিয়ে দেব এখন । তোর জন্যে আজ লজঞ্জস কিনে রেখেছিলুম, সেও আজ খেয়ে কাজ নেই। তুই এখানে চুপ করে পড়ে থাক, আমি খানিকটা পাচন তৈরি করে নিয়ে আসি ।” r এই বলিয়া তাহার ঘরে শিকল দিয়া সুবলচন্দ্র খুব তিতো পাচন তৈয়ার করিয়া আনিতে গেলেন । সুশীল মহা মুশকিলে পড়িয়া গেল। লজঞ্জস সে যেমন ভালোবাসিত পাচন খাইতে হইলে তাহার তেমনি সর্বনাশ বোধ হইত । ও দিকে আবার বোসেন্দের বাড়ি যাইবার জন্য কাল রাত হইতে তাহার মন ছটফটু করিতেছে, তাহাও বুঝি বন্ধ হইল । সুবলবাবু যখন খুব বড়ো এক বাটি পাচন লইয়া ঘরে ঢুকিলেন সুশীল বিছানা হইতে ধড়ফড়, করিয়া উঠিয়া বলিল, “আমার পেট কামড়ানো একেবারে সেরে গেছে, আমি আজ ইস্কুলে যাব ।” বাবা বলিলেন, “না না, সে কােজ নেই, তুই পাচন খেয়ে এইখানে চুপচাপ করে শুয়ে থাক।” এই বলিয়া তাহাকে জোর করিয়া পাচন খাওয়াইয়া ঘরে তালা লাগাইয়া বাহির হইয়া গেলেন । সুশীল বিছানায় পড়িয়া কঁদিতে কঁাদিতে সমস্তদিন ধরিয়া কেবল মনে করিতে লাগিল যে, “আহা, যদি কালই আমার বাবার মতো বয়স হয়, আমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারি, আমাকে কেউ বন্ধ করে রাখতে পারে না ।” তাহার বাপ সুবলবাবু বাহিরে একলা বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন যে, “আমার বাপ মা আমাকে বড়ো বেশি আদর দিতেন বলেই তো আমার ভালোরকম পড়াশুনো কিছু হল না । আহা, আবার যদি সেই ছেলেবেলা ফিরে পাই, তা হলে আর কিছুতেই সময় নষ্ট না করে কেবল পড়াশুনো করে নিই।” ইচ্ছঠাকরুন সেই সময় ঘরের বাহির দিয়া যাইতেছিলেন । তিনি বাপের ও ছেলের মনের ইচ্ছা! জানিতে পারিয়া ভাবিলেন, “আচ্ছা, ভালো, কিছুদিন ইহাদের ইচ্ছা পূর্ণ করিয়াই দেখা যাক ৷” এই ভাবিয়া ব্যাপকে গিয়া বলিলেন, “তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হইবে । কাল হইতে তুমি ছেলের বয়স পাইবে ।” ছেলেকে গিয়া বলিলেন, “কাল হইতে তুমি তোমার বাপের বয়সী হইবে।” শুনিয়া দুইজনে ভারি খুশি হইয়া উঠিলেন । বৃদ্ধ সুবলচন্দ্র রাত্রে ভালো ঘুমাইতে পারিতেন না, ভোরের দিকটায় ঘুমাইতেন । কিন্তু আজ তাহার । কী হইল, হঠাৎ খুব ভোরে উঠিয়া একেবারে লাফ দিয়া বিছানা হইতে নামিয়া পড়িলেন। দেখিলেন, খুব ছোটাে হইয়া গেছেন ; পড়া দাঁত সবগুলি উঠিয়াছে ; মুখের গোফদাড়ি সমস্ত কোথায় গেছে, তাহার। আর চিহ্ন নাই । রাত্রে যে ধুতি এবং জামা পরিয়া শুইয়াছিলেন, সকালবেলায় তাহা এত চিলা হইয়া গেছে যে, হাতের দুই আস্তিন প্ৰায় মাটি পর্যন্ত বুলিয়া পড়িয়াছে, জামার গলা বুক পর্যন্ত নামিয়াছে, ধুতির কেঁচাটা এতই লুটাইতেছে যে, পা ফেলিয়া চলাই দায় । আমাদের সুশীলচন্দ্ৰ অন্যদিন ভোরে উঠিয়া চারি দিকে দৌরাত্ম্য করিয়া বেড়ান, কিন্তু আজ তাহার ঘুম আর ভাঙে না ; যখন তাহার বাপ সুবলচন্দ্রের চেঁচামেচিতে সে জাগিয়া উঠিল তখন দেখিল,