পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

se weዕbr6ነ কাপড়-চোপড়গুলো গায়ে এমনি আঁটিয়া গেছে যে, ছিডিয়া ফাটিয়া কুটিকুটি হইবার জো হইয়াছে ; শরীরটা সমস্ত বাড়িয়া উঠিয়াছে ; কঁচা-পাকা গোফো-দাড়িতে অর্ধেকটা মুখ দেখাই যায় না ; মাথায় একমাথা চুল ছিল, হাত দিয়া দেখে সামনে চুল নাই- পরিষ্কার টাক তকতক করিতেছে। আজ সকালে সুশীলচন্দ্ৰ বিছানা ছাড়িয়া উঠিতেই চায় না। অনেকবার তুড়ি দিয়া উচ্চৈঃস্বরে হাই তুলিল ; অনেকবার এপােশ ওপাশ করিল ; শেষকালে বাপ সুবলচন্দ্রের গোলমালে ভারি বিরক্ত হইয়া উঠিয়া পড়িল । দুইজনের মনের ইচ্ছা পূর্ণ হইল বটে, কিন্তু ভারি মুশকিল বাধিয়া গেল। আগেই বলিয়াছি, সুশীলচন্দ্ৰ মনে করিত যে, সে যদি তাহার বাবা সুবলচন্দ্রের মতো বড়ো এবং স্বাধীন হয়, তবে যেমন ইচ্ছা গাছে চড়িয়া, জলে ঝাপ দিয়া, কঁচা আম খাইয়া, পাখির বাচ্ছা পাড়িয়া, দেশময় ঘুরিয়া বেড়াইবে ; যখন ইচ্ছা ঘরে আসিয়া যাহা ইচ্ছা তাহাই খাইবে, কেহ বারণ করিবার থাকিবে না । কিন্তু আশ্চর্য এই, সেদিন সকালে উঠিয়া তাহার গাছে চড়িতে ইচ্ছাই হইল না। পানাপুকুরটা দেখিয়া তাহার মনে হইল, ইহাতে ঝাপ দিলেই আমার কাপুনি দিয়া জ্বর আসিবে । চুপচাপ করিয়া দাওয়ায় একটা মাদুর পাতিয়া বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল । একবার মনে হইল, খেলাধুলোগুলো একেবারেই ছাড়িয়া দেওয়াটা ভালো হয় না, একবার চেষ্টা করিয়াই দেখা যাক । এই ভাবিয়া কাছে একটা আমড়া গাছ ছিল, সেইটাতে উঠিবার জন্য অনেকরকম চেষ্টা করিল। কাল যে গাছটাতে কাঠবিড়ালির মতো তার তাঁর করিয়া চড়িতে পারিত আজ বুড়া শরীর লইয়া সে গাছে কিছুতেই উঠিতে পারিল না ; নিচেকার একটা কচি ডাল ধরিবামাত্র সেটা তাহার শরীরের ভারে ভাঙিয়া গেল এবং বুড়া সুশীল ধাপ করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। কাছে রাস্তা দিয়া লোক চলিতেছিল, তাহারা বুড়াকে ছেলেমানুষের মতো গাছে চড়িতে ও পড়িতে দেখিয়া হাসিয়া অস্থির হইয়া গেল । সুশীলচন্দ্ৰ লজ্জায় মুখ নিচু করিয়া আবার সেই দাওয়ায় মাদুরে আসিয়া বসিল ; চাকরকে বলিল, “ওরে, বাজার থেকে এক টাকার লজঞ্জস কিনে আন ।” লজঞ্জসের প্রতি সুশীলচন্দ্রের বড়ো লোভ ছিল। স্কুলের ধারে দোকানে সে রোজ নানা রঙের লজঞ্জস সাজানো দেখিত ; দু-চার পয়সা যাহা পাইত তাহাতেই লজঞ্জস কিনিয়া খাইত ; মনে করিত, যখন বাবার মতো টাকা হইবে তখন কেবল পকেট ভরিয়া ভরিয়া লজঞ্জস কিনিবে এবং খাইবে । আজ চাকর এক টাকায় একরাশ লজঞ্জস কিনিয়া আনিয়া দিল ; তাহারই একটা লইয়া সে দন্তহীন মুখের মধ্যে পুরিয়া চুষিতে লাগিল ; কিন্তু বুড়ার মুখে ছেলেমানুষের লজঞ্জস কিছুতেই ভালো লাগিল না। একবার ভাবিল “এগুলো আমার ছেলেমানুষ বাবাকে খাইতে দেওয়া যাক’ ; আবার তখনই মনে হইল। ‘না কাজ নাই, এত লজজুস খাইলে উহার আবার অসুখ করিবে ।” কাল পর্যন্ত যে-সকল ছেলে সুশীলচন্দ্রের সঙ্গে কপাটি খেলিয়াছে আজ তাহারা সুশীলের সন্ধানে আসিয়া বুড়ো সুশীলকে দেখিয়া দূরে ছুটিয়া গেল । সুশীল ভাবিয়াছিল, বাপের মতো স্বাধীন হইলে তাহার সমস্ত ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে সমস্তদিন ধরিয়া কেবলই ডুডু ডুডু শব্দে কপাটি খেলিয়া বেড়াইবে ; কিন্তু আজ রাখাল গোপাল অক্ষয় নিবাৱণ হরিশ এবং নন্দকে দেখিয়া মনে মনে বিরক্ত হইয়া উঠিল ; ভাবিল, চুপচাপ করিয়া বসিয়া আছি, এখনই বুঝি ছোড়াগুলো গোলমাল বাধাইয়া দিবে। ” আগেই বলিয়াছি, বাবা সুবলচন্দ্ৰ প্ৰতিদিন দাওয়ায় মাদুর পাতিয়া বসিয়া বসিয়া ভাবিতেন, যখন ছােটাে ছিলাম তখন দুষ্টামি করিয়া সময় নষ্ট করিয়াছি, ছেলেবয়স ফিরিয়া পাইলে সমস্তদিন শান্ত শিষ্ট হইয়া, ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া বসিয়া কেবল বই লইয়া পড়া মুখস্থ করি । এমন-কি, সন্ধ্যার পরে সুকুমার কাছে গল্প শোনাও বদ্ধ করিয়া প্ৰদীপ জ্বলিয়া বাৰি দশটা এগারোটা পর্যন্ত পড়া তৈয়ারি কিন্তু ছেলেবয়স ফিরিয়া পাইয়া সুবলচন্দ্ৰ কিছুতেই স্কুলমুখো হইতে চাহেন না । সুশীল বিরক্ত হইয়া আসিয়া বলিত, “বাবা, ইস্কুলে যাবে না ?” সুবল মাথা চুলকাইয়া মুখ নিচু করিয়া আন্তে আন্তে