পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VObrN2 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বলিতেন, “আজ আমার পেট কামড়াচ্ছে, আমি ইস্কুলে যেতে পারব না।” সুশীল রাগ করিয়া বলিত, “পারবে না। বৈকি ! ইস্কুলে যাবার সময় আমারও আমন ঢের পেট কামড়েছে, আমি ও-সব জানি।” বাস্তবিক সুশীল এতরকম উপায়ে স্কুল পলাইত এবং সে এত অল্পদিনের কথা যে, তাহাকে ফাকি দেওয়া তাহার বাপের কর্ম নহে। সুশীল জোর করিয়া ক্ষুদ্র ব্যাপটিকে স্কুলে পাঠাইতে আরম্ভ করিল। স্কুলের ছুটির পরে সুবল বাড়ি আসিয়া খুব একচেটি দুটাছুটি করিয়া খেলিয়া বেড়াইবার জন্য অস্থির হইয়া পড়িতেন ; কিন্তু ঠিক সেই সময়টিতে বৃদ্ধ সুশীলচন্দ্ৰ চোখে চশমা দিয়া একখানা কৃত্তিবাসের রামায়ণ লইয়া সুর করিয়া করিয়া পড়িত, সুবলের ছুটািছুটি গোলমালে তাহার পড়ার ব্যাঘাত হইত। তাই সে জোর করিয়া সুবলকে ধরিয়া সম্মুখে বসাইয়া হাতে একখানা প্লেট দিয়া আঁকি কষিতে দিত। আঁকগুলো এমনি বড়ো বড়ো বাছিয়া দিত যে, তাহার একটা কষিতেই তাহার বাপের একঘণ্টা চলিয়া য়াইত । সন্ধ্যাবেলায় বুড়া সুশীলের ঘরে অনেক বুড়ায় মিলিয়া দাবা খেলিত । সে সময়টায় সুবিলকে ঠাণ্ডা। রাখিবার জন্য সুশীল একজন মাস্টার রাখিয়া দিল ; মাস্টার রাত্রি দশটা পর্যন্ত তাহাকে পড়াইত । খাওয়ার বিষয়ে সুশীলের বড়ো কড়াকড়ি ছিল । কারণ তাহার বাপ সুবল যখন বৃদ্ধ ছিলেন তখন তাহার খাওয়া ভালো হজম হইত না, একটু বেশি খাইলেই অম্বল হইত- সুশীলের সে কথাটা বেশ মনে আছে, সেইজন্য সে তাহার ব্যাপকে কিছুতেই অধিক খাইতে দিত না । কিন্তু হঠাৎ অল্পবয়স হইয়া আজকাল তাহার এমনি ক্ষুধা হইয়াছে যে, নুড়ি হজম করিয়া ফেলিতে পারিতেন । সুশীল তাহাকে যতই অল্প খাইতে দিত পেটের জ্বালায় তিনি ততই অস্থির হইয়া বেড়াইতেন । শেষকালে রোগ হইয়া শুকাইয়া তাহার সর্বাঙ্গের হাড় বাহির হইয়া পড়িল । সুশীল ভাবিল, শক্ত ব্যামো হইয়াছে ; তাই কেবলই ঔষধ গিলাইতে লাগিল । বুড়া সুশীলের বড়ো গোল বাধিল । সে তাহার পূর্বকালের অভ্যাসমত যাহা করে তাহাই তাহার সহ্য হয় না ; পূর্বে সে পাড়ায় কোথাও যাত্রাগানের খবর পাইলেই বাড়ি হইতে পালাইয়া, হিমে হােক, বৃষ্টিতে হােক, সেখানে গিয়া হাজির হইত। আজিকার বুড়া সুশীল সেই কাজ করিতে গিয়া, সর্দি হইয়া, কাসি হইয়া, গায়ে মাথায় ব্যথা হইয়া, তিনি হগুপ্ত শয্যাগত হইয়া পড়িয়া রহিল। চিরকাল সে পুকুরে স্নান করিয়া আসিয়াছে, আজও তাঁহাই করিতে গিয়া হাতের গাট পায়ের গােট ফুলিয়া বিষম বাত উপস্থিত হইল ; তাহার চিকিৎসা করিতে ছয় মাস গেল । তাহার পর হইতে দুই দিন অন্তর সে গরম জলে স্নান করিত এবং সুবলিকেও কিছুতেই পুকুরে স্নান করিতে দিত না । পূর্বেকার অভ্যাসমত, ভুলিয়া তক্তপোশ হইতে সে লাফ দিয়া নামিতে যায়, আর হাড়গুলো টনটন ঝনঝনি করিয়া উঠে । মুখের মধ্যে আস্ত পান পুরিয়াই হঠাৎ দেখে, দাত নাই, পান চিবানো অসাধ্য। ভুলিয়া চিরুনি ক্রুশ লইয়া মাথা আঁচড়াইতে গিয়া দেখে, প্ৰায় সকল মাথাতেইটাক । এক-একদিন হঠাৎ ভুলিয়া যাইত যে, সে তাহার বাপের বয়সী বুড়া হইয়াছে এবং ভুলিয়া পূর্বের অভ্যাসমত দুষ্টামি করিয়া পাড়ার বুড়ি আদি পিসির জলের কলসে হঠাৎ ঠন করিয়া চিল ষ্টুড়িয়া মারিত— বুড়ামানুষের এই ছেলেমানুবি দুষ্টামি দেখিয়া লোকেরা তাহাকে মার মারা করিয়া তাড়াইয়া যাইত, সেও লজ্জায় মুখ রাখিবার জায়গা পাইত व् । সুবলচন্দ্রও এক-একদিন দৈবাৎ ভুলিয়া যাইত যে, সে আজকাল ছেলেমানুব হইয়াছে। আপনাকে পূর্বের মতো বুড়া মনে করিয়া যেখানে বুড়ামানুষেরা তাস পাশা খেলিতেছে সেইখানে গিয়া সে বসিত এবং বুড়ার মতো কথা বলিত, শুনিয়া সকলেই তাহাকে “যা যা, খেলা করগে যা, জ্যাঠামি করতে হবে না” বলিয়া কান ধরিয়া বিদায় করিয়া দিত । হঠাৎ ভুলিয়া মাস্টারকে গিয়া বলিত, “দাও তো, তামাকটা দাও তো, খেয়ে নিই।” শুনিয়া মাস্টার তাহাকে বেঞ্চের উপর এক পায়ে দাড় করাইয়া দিত, নাপিতকে গিয়া বলিত, “ওরে বেজা, কি দিন আমাকে কামাতে আসিস নি কেন ।” নাপিত ভাবিত ছেলেটি খুব ঠাট্টা করিতে শিখিয়াছে। সে উত্তর দিত, “আর বছরদশেক বাদে আসব এখন ।” আবার এক-একদিন তাহার পূর্বের অভ্যাসমত। তাহার ছেলে সুশীলকে গিয়া মারিত। সুশীল ভারি রাগ করিয়া বলিত, “পড়াশুনো করে তোমার এই বুদ্ধি হচ্ছে ? একরাত্তি ছেলে হয়ে বুড়োমানুষের গায়ে হাত