পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VSb রবীন্দ্র-রচনাবলী । - সেইটোকে অন্য কিছুর মাপে তৈরি করা— নিজের প্রয়োজনের মাপে বা অন্যের প্রয়োজনের মাপে । আর, সৃষ্টি করা অন্য কোনো-কিছুর মাপের অপেক্ষা করে না, সে হচ্ছে নিজেকে সর্জন করা, নিজেকেই প্ৰকাশ করা । এইজন্য ভোগী পাখি যো-সমস্ত উপকরণ নিয়ে কাজ করছে তা প্ৰধানত বাইরের উপকরণ, আর দ্রষ্টা পাখির উপকরণ হচ্ছে। আমি-পদার্থ। এই আমির প্রকাশই সাহিত্য, আর্ট । তার মধ্যে কোনো দায়ই নেই, কর্তব্যের দায়ও না । পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়ো রহস্য- দেখবার বস্তুটি নয়, যে দেখে সেই মানুষটি । এই রহস্য আপনি আপনার ইয়ত্তা পাচ্ছে না ; হাজার হাজার অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে আপনাকে দেখতে চেষ্টা করছে। যা-কিছু ঘটছে এবং যা-কিছু ঘটতে পারে, সমস্তর ভিতর দিয়ে নিজেকে বাজিয়ে দেখছে। এই-যে আমার এক আমি, এ বহুর মধ্যে দিয়ে চ’লে চলে নিজেকে নিত্য উপলব্ধি করতে থাকে । বহুর সঙ্গে মানুষের সেই একের মিলনজাত রসের উপলব্ধিই হচ্ছে সাহিত্যের সামগ্ৰী । অর্থাৎ, দুষ্ট বস্তু নয়, দ্রষ্টা আমিই তার লক্ষ্য । তোসামারু জাহাজ ২০ বৈশাখ ১৩২৩ w) বৃহস্পতিবার বিকেলে সমুদ্রের মোহানায় পাইলট নেবে গেল । এর কিছু আগে থাকতেই সমুদ্রের রূপ দেখা দিয়েছে। তার কুলের বেড়ি খসে গেছে। কিন্তু, এখনো তার মাটির রঙ ঘোচে নি । পৃথিবীর চেয়ে আকাশের সঙ্গেই যে তার আত্মীয়তা বেশি, সে-কথা এখনো প্ৰকাশ হয় নি ; কেবল দেখা গেল জলে আকাশে এক দিগন্তের মালা বদল করেছে । যে ঢেউ দিয়েছে, নদীর ঢেউয়ের ছন্দের মতো তার ছোটাে ছোটাে পদবিভাগ নয় ; এ যেন মন্দাক্রান্তা, কিন্তু এখনো সমুদ্রের শাৰ্দলবিক্ৰীড়িত শুরু হয় নি । আমাদের জাহাজের নীচের তলার ডেকে অনেকগুলি ডেক-প্যাসেঞ্জার ; তাদের অধিকাংশ মাদ্রাজি, এবং তারা প্ৰায় সকলেই রেঙ্গুনে যাচ্ছে । তাদের পরে এই জাহাজের লোকের ব্যবহারে কিছুমাত্র কঠোরতা নেই, তারা বেশ স্বচ্ছন্দে আছে । জাহাজের ভাণ্ডার থেকে তারা প্ৰত্যেকে একখানি করে ছবি আঁকা কাগজের পাখা পেয়ে ভারি খুশি হয়েছে। এরা অনেকেই হিন্দু, সুতরাং এদের পথের কষ্ট ঘোচানো কারো সাধ্য নয় । কোনোমতে আখ চিবিয়ে, চিড়ে খেয়ে এদের দিন যাচ্ছে । একটা জিনিস ভারি চোখে লাগে, সে হচ্ছে এই যে, এরা মোটের উপর পরিষ্কার- কিন্তু সেটা কেবল বিধানের গণ্ডির মধ্যে, বিধানের বাইরে এদের নোংরা। হবার কোনো বাধা নেই। আখ চিবিয়ে তার ছিবড়ে অতি সহজেই সমুদ্রে ফেলে দেওয়া যায়, কিন্তু সেটুকু কষ্ট নেওয়া এদের বিধানে নেই— যেখানে বসে খাচ্ছে তার নেহাত কাছে ছিবড়ে ফেলছে, এমনি করে চারি দিকে কত আবর্জনা যে জমে উঠছে তাতে এদের ভূক্ষেপ নেই ; সবচেয়ে আমাকে পীড়া দেয় যখন দেখি থুথু ফেলা সম্বন্ধে এরা বিচার করে না । অথচ, বিধান অনুসারে শুচিত রক্ষা করবার বেলায় নিতান্ত সামান্য বিষয়েও এরা অসামান্য রকম কষ্ট স্বীকার করে । আচারকে শক্ত করে তুললে বিচারকে ঢিলে করতেই হয়। বাইরে থেকে মানুষকে বাধলে মানুষ আপনাকে আপনি বাধবার শক্তি হারায় । এদের মধ্যে কয়েকজন মুসলমান আছে ; পরিষ্কার হওয়া সম্বন্ধে তারা যে বিশেষ সতর্ক তা নয়, কিন্তু পরিচ্ছন্নতা সম্বন্ধে তাদের ভারি সতর্কতা । ভালো কাপড়টি পরে টুপিটি বাগিয়ে তারা সর্বদা প্ৰস্তুত থাকতে চায় । একটুমাত্র পরিচয় হলেই অথবা না হলেও তারা দেখা হলেই প্ৰসন্নমুখে সেলাম করে । বোঝা যায়, তারা বাইরের সংসারটাকে মানে । কেবলমাত্র নিজের জাতের গণ্ডির মধ্যে যারা থাকে তাদের কাছে সেই গণ্ডির বাইরেকার লোকালয় নিতান্ত ফিকে । তাদের সমস্ত বাধাবিধি