পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

छाPlन्म-याउँी 8ంరి ছিল না । সেইজন্যেই কলকাতা আধুনিক শহর হলেও কোকিলশিশুর মতো তার পালনকত্রীর নীড়কে লাগল ততই দেশের রূপ আচ্ছন্ন হতে চলল। এখন কলকাতা বাংলাদেশকে আপনার চারি দিক থেকে নির্বাসিত করে দিচ্ছে । দেশ ও কালের লড়াইয়ে দেশের শ্যামল শোভা পরাভূত হল, কালের করাল মূর্তিই লোহার দাঁত নখ মেলে কালো নিশ্বাস ছাড়তে লাগল। এক সময়ে মানুষ বলেছিল, বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ । তখন মানুষ লক্ষ্মীর যে-পরিচয় পেয়েছিল। সে তো কেবল ঐশ্বর্যে নয়, তার সৌন্দর্যে । তার কারণ, বাণিজ্যের সঙ্গে তখন মনুষ্যত্বের বিচ্ছেদ ঘটে নি । তাতের সঙ্গে তাতির, কামারের হাতুড়ির সঙ্গে কামারের হাতের, কারিগরের সঙ্গে তার কারুকার্যের মনের মিল ছিল । এইজন্যে বাণিজ্যের ভিতর দিয়ে মানুষের হৃদয় আপনাকে ঐশ্বর্যে বিচিত্ৰ ক’রে সুন্দর ক'রে ব্যক্ত করত । নইলে লক্ষ্মী তার পদ্মাসন পেতেন কোথা থেকে । যখন থেকে কল হল বাণিজ্যের বাহন তখন থেকে বাণিজ্য হল শ্ৰীহীন । প্ৰাচীন ভেনিসের সঙ্গে আধুনিক ম্যাঞ্চেস্টরের তুলনা করলেই তফাতটা স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাবে । ভেনিসে সৌন্দর্যে এবং ঐশ্বর্যে মানুষ আপনারই পরিচয় দিয়েছে, ম্যাঞ্চেস্টারে মানুষ সব দিকে আপনাকে খর্ব করে আপনার কলের পরিচয় দিয়েছে । এইজন্য কল-বাহন বাণিজ্য যেখানেই গেছে সেখানেই আপনার কালিমায় কদৰ্যতায় নির্মমতায় একটা লোলুপতার মহামারী সমস্ত পৃথিবীতে বিস্তীর্ণ করে দিচ্ছে । তাই নিযে কাটাকাটি-হানাহানির আর অন্ত নেই ; তাই নিয়ে অসত্যে লোকালয় কলঙ্কিত এবং রক্তপাতে ধরাতল পঙ্কিল হয়ে উঠল । অন্নপূর্ণ আক্ত হয়েছেন কালী ; তার অন্নপরিবেশনের হাতা আজ হয়েছে রক্তপান করবার খপর । তার স্মিতহাস্য আজ অট্টহাস্যে ভীষণ হল । যাই হোক, আমার বলবার কথা এই যে, বাণিজ্য মানুষকে প্ৰকাশ করে না, মানুষকে প্রচ্ছন্ন করে । তাই বলছি, রেঙ্গুন তো দেখলুম। কিন্তু সে কেবল চোখের দেখা, সে দেখার মধ্যে কোনো পরিচয় নেই ; সেখান থেকে আমার বাঙালি বন্ধুদের আতিথ্যের স্মৃতি নিয়ে এসেছি, কিন্তু ব্ৰহ্মদেশের হাত থেকে কোনো দক্ষিণা আনতে পারি নি । কথাটা হয়তো একটু অত্যক্তি হয়ে পড়ল । আধুনিকতার এই প্রাচীরের মধ্যে দেশের একটা গবাক্ষ হঠাৎ একটু খােলা পেয়েছিলুম। সোমবার দিন সকালে আমার বন্ধুরা এখানকার বিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দিরে নিয়ে গেলেন । এতক্ষণে একটা-কিছু দেখতে পেলুম । এতক্ষণ যার মধ্যে ছিলুম। সে একটা অ্যাবসট্রাকশন, সে একটা অবচ্ছিন্ন পদার্থ । সে একটা শহর, কিন্তু কোনো-একটা শহরই নয় । এখন যা দেখছি তার নিজেরই একটা বিশেষ চেহারা আছে। তাই সমস্ত মন খুশি হয়ে সজাগ হয়ে উঠল । আধুনিক বাঙালির ঘরে মাঝে মাঝে খুব ফ্যাশানওয়ালা মেয়ে দেখতে পাই ; তারা খুব গট্টগট করে চলে, খুব চটপট করে ইংরেজি কয় ; দেখে মস্ত একটা অভাব মনে বাজে ; মনে হয় ফ্যাশানটাকেই বড়ো করে দেখছি, বাঙালির মেয়েটিকে নয় ; এমন সময় হঠাৎ ফ্যাশানজালমুক্ত সরল সুন্দর স্নিগ্ধ বাঙালি-ঘরের কল্যাণীকে দেখলে তখনই বুঝতে পারি, এ তো মরীচিকা নয়, স্বচ্ছ গভীর সরোবরের মতো এর মধ্যে একটি তৃষাহরণ পূর্ণতা আপন পদ্মবনের পাড়টি নিয়ে টলটল করছে। মন্দিরের মধ্যে ঢুকতেই আমার মনে তেমনি একটি আনন্দের চমক লাগিল ; মনে হল, যাই হােক-না কেন, এটা ফাকা নয়, যেটুকু চোখে পড়ছে এ তার চেয়ে আরো অনেক বেশি । সমস্ত রেঙ্গুন শহরটা এর কাছে ছোটাে হয়ে গেল ; বহুকালের বৃহৎ ব্ৰহ্মদেশ এই মন্দিরটুকুর মধ্যে আপনাকে প্ৰকাশ করলে । প্রথমেই বাইরের প্রখর আলোর থেকে একটি পুরাতন কালের পরিণত ছায়ার মধ্যে এসে প্রবেশ করলুম। । থাকে থাকে প্রশস্ত সিঁড়ি উঠে চলেছে ; তার উপরে আচ্ছাদন । এই সিঁড়ির দুই ধারে ফল ফুল বাতি, পূজার অর্ঘ্য বিক্রি চলছে। যারা বেচছে তারা অধিকাংশই ব্ৰক্ষীয় মেয়ে । ফুলের রঙের সঙ্গে তাদের রেশমের কাপড়ের রঙের মিল হয়ে মন্দিরের ছায়াটি সূর্যাস্তের আকাশের মতো বিচিত্র হয়ে উঠেছে । কেনাবেচার কোনো নিষেধ নেই, মুসলমান দোকানদারেরা বিলাতি মনিহারির দোকান খুলে বসে গেছে । মাছমাংসেরও বিচার নেই, চারি দিকে খাওয়াদাওয়া ঘরকন্না চলছে । সংসারের সঙ্গে