পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জাপান-যাত্রী 8०१ | অভ্যর্থনার জন্যে স্বৰ্গে মর্তে রাজকীয় সমারোহ। প্ৰভাতে পৃথিবী তার ঘোমটা খুলে দাড়ায়, তার বাণী । নানা সুরে জেগে ওঠে ; সন্ধ্যায় স্বৰ্গলোকের যবনিকা উঠে যায়, এবং দ্যলোক আপন জ্যোতি-রোমাঞ্চিত নিঃশব্দতার দ্বারা পৃথিবীর সম্ভাষণে উত্তর দেয়। স্বৰ্গমর্তের এই মুখোমুখি আলাপ যে কত গভীর এবং কত মহীয়ান, এই আকাশ ও সমুদ্রের মাঝখানে দাড়িয়ে তা আমরা বুঝতে পারি। দিগন্ত থেকে দেখতে পাই, মেঘগুলো নানা ভঙ্গিতে আকাশে উঠে চলেছে, যেন সৃষ্টিকর্তার আঙিনার আকার-ফোয়ারার মুখ খুলে গেছে। বস্তু প্ৰায় কিছুই নেই, কেবল আকৃতি, কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই। নানা রকমের আকার- কেবল সোজা লাইন নেই। সোজা লাইনটা মানুষের হাতের কাজের । তার ঘরের দেওয়ালে, তার কারখানাঘরের চিমনিতে মানুষের জয়স্তম্ভ একেবারে সোজা খাড়া । বাকা রেখা জীবনের রেখা, মানুষ সহজে তাকে আয়ত্ত করতে পারে না । সোজা রেখা জড় রেখা, সে সহজেই মানুষের শাসন মানে ; সে মানুষের বোঝা বয়, মানুষের অত্যাচার সয় । যেমন আকৃতির হরির লুঠ, তেমনি রঙের । রঙ যে কত রকম হতে পারে, তার সীমা নেই। রঙের তান উঠছে, তানের উপর তান ; তাদের মিলও যেমন, তাদের অমিলও তেমনি ; তারা বিরুদ্ধ নয়, অথচ বিচিত্র । রঙের সমারোহেও যেমন প্রকৃতির বিলাস, রঙের শাস্তিতেও তেমনি । সূর্যাস্তের মুহুর্তে পশ্চিম আকাশ যেখানে রঙের ঐশ্বৰ্য পাগলের মতো দুই হাতে বিনা প্রয়োজনে ছড়িয়ে দিচ্ছে সেও যেমন আশ্চর্য, পূর্ব আকাশে যেখানে শান্তি এবং সংযম, সেখানেও রঙের পেলাবতা, কোমলতা, অপরিমেয় গভীরতা তেমনি আশ্চর্য। প্ৰকৃতির হাতে অপর্যাপ্তও যেমন মহৎ হতে পারে, পর্যাপ্তও তেমনি । সূর্যাস্তে সূর্যোদয়ে প্রকৃতি আপনার ডাইনে বঁায়ে একই কালে সেটা দেখিয়ে দেয় ; তার খেয়াল আর ধ্রুপদ একই সঙ্গে বাজতে থাকে, অথচ কেউ কারো মহিমাকে আঘাত করে না । তার পরে, রঙের আভায় আভায় জল যে কত বিচিত্র কথাই বলতে পারে তা কেমন করে বর্ণনা করব । সে তার জলতরঙ্গে রঙের যে গৎ বাজাতে থাকে, তাতে সুরের চেয়ে শ্রুতি অসংখ্য । আকাশ যে-সময়ে তার প্রশান্ত স্তব্ধতার উপর রঙের মহতোমহীয়ানকে দেখায় সমুদ্র সেইসময় তার ছোটাে ছোটো লহরীর কম্পনে রঙের অণেরণীয়ানকে দেখাতে থাকে, তখন আশ্চর্যের অন্ত পাওয়া যায় না । সমুদ্র-আকাশের গীতিনাট্যলীলায় রুদ্রের প্রকাশ কী রকম দেখা গেছে, সে পূর্বেই বলেছি। আবার কালও তিনি তার ডমরু বাজিয়ে অট্টহাস্যে আর এক ভঙ্গিতে দেখা দিয়ে গেলেন । সকালে আকাশ জুড়ে নীল মেঘ এবং ধোয়ালো মেঘ স্তরে স্তরে পাকিয়ে পাকিয়ে ফুলে ফুলে উঠল । মুষলধারে বৃষ্টি । বিদ্যুৎ আমাদের জাহাজের চার দিকে তার তলোয়ার খেলিয়ে বেড়াতে লাগিল । তার পিছনে পিছনে বজের গর্জন । একটা বীজ ঠিক আমাদের সামনে জলের উপর পড়ল, জল থেকে একটা বাস্পরেখা সাপের মতো ফোস করে উঠল । আর-একটা ব্যঞ্জ পড়ল আমাদের সামনেকার মাত্তলে । রুদ্র যেন গেলেন, মাস্তুলের ডগাটায় তার বাণ লাগল, আমাদের স্পর্শ করল না । এই ঝড়ে আমাদের সঙ্গী আর-একটা জাহাজের প্রধান মাস্তুল বজে বিদীর্ণ হয়েছে শুনলুম। মানুষ যে বঁাচে এই আশ্চর্য । Գ এই কয়দিন আকাশ এবং সমুদ্রের দিকে চােখ ভরে দেখছি আর মনে হচ্ছে, অনন্তের রঙ তো শুভ্ৰ নয়, তা কালো কিংবা নীল। এই আকাশ খানিক দূর পর্যন্ত আকাশ অর্থাৎ প্রকাশ, ততটা সে সাদা । তার পরে সে অব্যক্ত, সেইখান থেকে সে নীল। আলো যতদূর সীমার রাজ্য সেই পর্যন্ত ; তার পরেই অসীম অন্ধকার । সেই অসীম অন্ধকারের বুকের উপরে এই পৃথিবীর আলোকময় দিনটুকু যেন কীেস্তুভমণির হার দুলছে। এই প্রকাশের জগৎ, এই গৌরাঙ্গী, তার বিচিত্র রঙের সাজ পরে অভিসারে চলেছে- ঐ কালোর দিকে, ঐ অনির্বচনীয় অব্যক্তের দিকে । বাধা নিয়মের মধ্যে বাধা থাকাতেই তার মরণ- সে কুলকেই