পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জাপান-যাত্রী 8 S \o স্বভাবসিদ্ধ ; এই মেয়েটির মধ্যে আমরাই তার পরিচয় পেয়েছি । তার পরে, কর্মকুশলতা মেয়েদের স্বাভাবিক । পুরুষ স্বভাবত কুঁড়ে, দায়ে পড়ে তাদের কাজ করতে হয় । মেয়েদের মধ্যে একটা প্ৰাণের প্রাচুর্য আছে যার স্বাভাবিক বিকাশ হচ্ছে কর্মপরতা। কর্মের সমস্ত খুঁটিনাটি যে কেবল ওরা সহ্য করতে পারে তা নয়, তাতে ওরা আনন্দ পায়। তা ছাড়া দেনাপাওনা সম্বন্ধে ওরা সাবধানী। এইজন্যে, যে-সব কাজে দৈহিক বা মানসিক সাহসিকতার দরকার হয় না সে-সব কাজ মেয়েরা, পুরুষের চেয়ে ঢের ভালো করে করতে পারে, এই আমার বিশ্বাস । স্বামী যেখানে সংসার ছারখার করেছে সেখানে স্বামীর অবর্তমানে স্ত্রীর হাতে সংসার পড়ে সমস্ত সুশৃঙ্খলায় রক্ষা পেয়েছে, আমাদের দেশে তার বিস্তর প্রমাণ আছে। শুনেছি, ফ্রান্সের মেয়েরাও ব্যবসায়ে আপনাদের কর্মনৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছে। যে-সব কাজে উদ্ভাবনার দরকার নেই, যে-সব কাজে পটুতা পরিশ্রম ও লোকের সঙ্গে ব্যবহারই সবচেয়ে দরকার, সে-সব কাজ মেয়েদের । ৩রা জ্যৈষ্ঠ সকালে আমাদের জাহাজ ছাড়লে । ঠিক এই ছাড়বার সময় একটি বিড়াল জলের মধ্যে পড়ে গেল। তখন সমস্ত ব্যস্ততা ঘুচে গিয়ে, ঐ বিড়ালকে বাচানোই প্রধান কাজ হয়ে উঠল। নানা উপায়ে নানা কৌশলে তাকে জল থেকে উঠিয়ে তবে জাহাজ ছাড়লে । এতে জাহাজ ছাড়ার নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেল । এইটিতে আমাকে বড়ো আনন্দ দিয়েছে । চীন সমুদ্র তোসামারু জাহাজ ৮ই জ্যৈষ্ঠ ১৩২৩ O সমুদ্রের উপর দিয়ে আমাদের দিনগুলি ভেসে চলেছে পালের নীেকার মতো । সে নীেকা কোনো ঘাটে যাবার নৌকা নয়, তাতে কোনো বোঝাই নেই । কেবলমাত্র ঢেউয়ের সঙ্গে, বাতাসের সঙ্গে, আকাশের সঙ্গে কোলাকুলি করতে তারা বেরিয়েছে। মানুষের লোকালয় মানুষের বিশ্বের প্রতিদ্বন্দ্বী । সেই লোকালয়ের দাবি মিটিয়ে সময় পাওয়া যায় না, বিশ্বের নিমন্ত্রণ আর রাখতেই পারি। নে । চাদ যেমন তার একটা মুখ সূর্যের দিকে ফিরিয়ে রেখেছে, তার আর-একটা মুখ অন্ধকার, তেমনি লোকালয়ের প্রচণ্ড টানে মানুষের সেই দিকের পিঠটাতেই চেতনার সমস্ত আলো খেলছে, অন্য একটা দিক আমরা ভুলেই গেছি ; বিশ্ব যে মানুষের কতখানি, সে আমাদের খেয়ালেই আসে না । । সত্যকে যেদিকে ভুলি কেবল যে সেই দিকেই লোকসান তা নয়, সে লোকসান সকল দিকেই। বিশ্বকে মানুষ যে পরিমাণে যতখানি বাদ দিয়ে চলে তার লোকালয়ের তাপ এবং কলুষ সেই পরিমাণে ততখানি বেড়ে ওঠে । সেইজন্যেই ক্ষণে ক্ষণে মানুষের একেবারে উলটােদিকে টান আসে । সে বলে, "বৈরাগ্যমেবাভয়ং”- বৈরাগ্যের কোনো বালাই নেই। সে বলে বসে, সংসার কারাগার ; মুক্তি খুঁজতে, শান্তি খুঁজতে সে বনে পর্বতে সমুদ্রতীরে ছুটে যায়। মানুষ সংসারের সঙ্গে বিশ্বের বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে বলেই বড়ো করে প্রাণের নিশ্বাস নেবার জন্যে তাকে সংসার ছেড়ে বিশ্বের দিকে যেতে হয় । এতবড়ো অদ্ভুত কথা তাই মানুষকে বলতে হয়েছে- মানুষের মুক্তির রাস্তা মানুষের কাছ থেকে দূরে । 鞑 লোকালয়ের মধ্যে যখন থাকি অবকাশ জিনিসটাকে তখন ডরাই। কেননা, লোকালয় জিনিসটা - একটা নিরেট জিনিস, তার মধ্যে ফাকমাত্রই ফাকা । সেই ফাকটাকে কোনোমতে চাপা দেবার জন্যে আমাদের মদ চাই, তাস পাশা চাই, রাজাউজির মারা চাই- নইলে সময় কাটে না । অৰ্থাৎ সময়টাকে আমরা চাই নে, সময়টাকে আমরা বাদ দিতে চাই ।