পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী وما لا 8 পারা যায়, বিশ্বের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য নেই ; বিশ্বশক্তির সঙ্গে তার শক্তির নিরন্তর সংঘর্ষ হতে হতে একদিন তাকে হার মেনে হাল ছেড়ে তলিয়ে যেতে হবেই। প্ৰকৃতির গৃহিণীপনা কখনোই কদৰ্য অমিতাচারকে অধিক দিন সইতে পারে না ; তার বঁাটা এসে পড়ল বলে । বাণিজ্য দানবটা নিজের বিরূপতায়, নিজের প্রকাণ্ড ভারের মধ্যে নিজের প্রাণদণ্ড বহন করছে । একদিন আসছে। যখন তার লোহার কঙ্কালগুলোকে আমাদের যুগের স্তরের মধ্যে থেকে আবিষ্কার করে পুরাতত্ত্ববিদরা এই সর্বভুক। প্ৰাণীজগতে মানুষের যে যোগ্যতা, সে তার দেহের প্রাচুর্য নিয়ে নয়। মানুষের চামড়া নরম, তার গায়ের জোর অল্প, তার ইন্দ্ৰিয়াশক্তিও পশুদের চেয়ে কম বৈ বেশি নয় । কিন্তু, সে এমন একটি বল। পেয়েছে যা চোখে দেখা যায় না, যা জায়গা জোড়ে না, যা কোনো স্থানের উপর ভর না করেও সমস্ত জগতে আপন অধিকার বিস্তার করছে । মানুষের মধ্যে দেহপরিধি দৃশ্যজগৎ থেকে সরে গিয়ে অদৃশ্যের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছে। বাইবেলে আছে, যে নম্র সেই পৃথিবীকে অধিকার করবে ; তার মানেই হচ্ছে, নম্রতার শক্তি বাইরে নয়, ভিতরে- সে যত কম আঘাত দেয় ততই সে জয়ী হয় । সে রণক্ষেত্রে লড়াই করে না ; অদৃশ্যলোকে বিশ্বশক্তির সঙ্গে সন্ধি করে সে জয়ী হয় । বাণিজ্যদানবকেও একদিন তার দানবলীলা সংবরণ করে মানব হতে হবে । আজ এই বাণিজ্যের মস্তিষ্ক কম, ওর হৃদয় তো একেবারেই নেই ; সেইজন্যে পৃথিবীতে ও কেবল আপনার ভার বাড়িয়ে চলেছে । কেবলমাত্ৰ প্ৰাণপণ শক্তিতে আপনার আয়তনকে বিস্তীর্ণতর করে করেই ও জিততে চাচ্ছে । কিন্তু, একদিন যে জয়ী হবে তার আকার ছোটো, তার কর্মপ্রণালী সহজ ; মানুষের হৃদয়কে, সৌন্দর্যবোধকে, ধর্মবুদ্ধিকে সে মানে ; সে নম্র, সে সুশ্ৰী, সে কদৰ্যভাবে লুব্ধ নয় ; তার প্রতিষ্ঠা অন্তরের সুব্যবস্থায়, বাইরের আয়তনে না ; সে কাউকে বঞ্চিত করে বড়ো নয়, সে সকলের সঙ্গে সন্ধি ক'রে বড়ো । আজকের দিনে পৃথিবীতে মানুষের সকল অনুষ্ঠানের মধ্যে এই বাণিজ্যের অনুষ্ঠান সব চেয়ে কুশ্ৰী ; আপন ভারের দ্বারা পৃথিবীকে সে ক্লান্ত করছে, আপন শব্দের দ্বারা পৃথিবীকে বধির করছে, আপনি আবর্জনার দ্বারা পৃথিবীকে মলিন করছে, আপনি লোভের দ্বারা পৃথিবীকে আহত করছে। এই যে পৃথিবীব্যাপী কুশীতা, এই যে বিদ্রোহ- রূপ রস শব্দ গন্ধ স্পর্শ এবং মানবহৃদয়ের বিরুদ্ধে- এই যে লোভকে বিশ্বের রাজসিংহাসনে বসিয়ে তার কাছে দাসখত লিখে দেওয়া, এ প্রতিদিনই মানুষের শ্রেষ্ঠ মনুষ্যত্বকে আঘাত করছেই, তার সন্দেহ নেই। মুনফার নেশায় উন্মত্ত হয়ে এই বিশ্বব্যাপী দ্যূতক্রীড়ায় মানুষ নিজেকে পণ রেখে কতদিন খেলা চালাবে ? এ খেলা ভাঙতেই হবে । যে-খেলায় মানুষ লাভ করবার লোভে নিজেকে লোকসান করে চলেছে, সে কখনোই চলবে କn || ৯ই জ্যৈষ্ঠ । মেঘ বৃষ্টি বাদল কুয়াশায় আকাশ ঝাপসা হয়ে আছে ; হংকং বন্দরের পাহাড়গুলো দেখা দিয়েছে, তাদের গা বেয়ে বেয়ে ঝরনা ঝরে পড়ছে। মনে হচ্ছে দৈত্যের দল সমুদ্রে ডুব দিয়ে তাদের ভিজে মাথা জলের উপর তুলেছে, তাদের জটা বেয়ে দাড়ি বেয়ে জল ঝরছে। এভুজ সাহেব বলছেন, দৃশ্যটা যেন পাহাড়-ঘেরা স্কটল্যান্ডের হ্রদের মতো ; তেমনিতরো ঘন সবুজ বেঁটে বেঁটে অল্প মুছে ফেলা জলস্থলের মূর্তি । কাল সমস্ত রাত বৃষ্টি বাতাস গিয়েছে ; কাল বিছানা আমার ভার বহন করে নি, আমিই বিছানাটাকে বহন করে ডেকের এধার থেকে ওধারে আশ্রয় খুঁজে খুঁজে ফিরেছি। রাত যখন সাড়ে দুপুর হবে, তখন এই বাদলের সঙ্গে মিথ্যা বিরোধ করবার চেষ্টা না করে তাকে প্ৰসন্ন মনে মেনে নেবার জন্যে প্ৰস্তুত হলুম। একাধারে দাড়িয়ে ঐ বাদলার সঙ্গে তান মিলিয়েই গান ধরলুম- শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে । এমনি করে ফিরে ফিরে অনেকগুলো গান গাইলুম, বানিয়ে বানিয়ে একটা নতুন গানও তৈরি করলুম, কিন্তু বাদলের সঙ্গে কবির লড়াইয়ে এই মর্তবাসীকেই হার মানতে হল । আমি অত দিম পাব কোথায়, আর আমার কবিত্বের বাতিক যতই প্ৰবল হােক-না, বায়ুবলে আকাশের সঙ্গে পেরে উঠব কেন ।